সেনদিদিই বিন্দুকে যন্ত্রণা দিল সবচেয়ে বেশি। শশীকে অবাক করিয়া কিছুদিন হইতে সেনদিদি হামেশা এ বাড়িতে আসিতেছিল। গোপালের সঙ্গে তার যেন একটা সন্ধি হইয়াছে। কুর্তায় ভুড়ি ঢাকিয়া গোপাল তামাক টান, অদূরে সিড়ি পাতিয়া বসিয়া সেনদিদি তার সঙ্গে করে আলাপ। সেনদিদির দাগী মুখ আর কানা চোখ দেখিয়া গোপালেরও যেন একটা রোগ আরাম হইয়া গিয়াছে। আজকাল সে প্রসন্ন প্রশান্ত। গ্রাম্য রমণীর আবেগপূর্ণ মমতায় সেনদিদি শশীকে আকর্ষণ করিত বটে এবং লাবণ্যবতীর স্নেহ স্বভাবতই মানুষ একটু বেশি পছন্দ করে বলিয়া সে মমতা দামিও ছিল শশীর কাছে। কিন্তু একথা শশী কখনও বিশ্বাস করে নাই যে পড়ন্ত সূর্যের মতো শেষ যৌবনের অত্যাশ্চর্য রূপের অস্ত্রে ছেলেকে বশ করিয়া গোপালের উপর একটা উপযুক্ত প্রতিরোধ গ্রহণের এতটুকু ইচ্ছাও সেনদিদির ছিল। গোপালের বাঁকা মন বাঁকা মানে খুঁজিত। তাই সেনদিদির বর্তমান শ্রীহীনতায় গোপালের প্রসন্নভাব শক্ৰ বুঝিতে পারে। বুঝিতে পারে না সেনদিদির আসা-যাওয়া। চিরকাল যে গল্প করিতে পারে, শশীকে তা যেন অপমান করে। মাঝে মাঝে হাসির কথাও বুঝি বলে গোপাল, কারণ সেনদিদির কুশ্রী মুখখানা অনিন্দ্য হাসিতে ভরিয়া যাইতেও দেখা যায়। শশী জানে, খুব অল্পবয়সে সেনদিদির ভার গোপালের ঘাড়ে পড়িয়াছিল। তারপর কত টাকার বিনিময়ে সেনদিদিকে গোপাল যামিনীর কাছে বিসর্জন দিয়াছিল তাও শশী জানেদেড়শো টাকা! গোপালের গ্রাম্য রসিকতায় সেই সেনদিদি আজ এমন অকুণ্ঠ হাসি হাসিতে পারে ভাবিলে গ্রামের উপরেই শশীর বিতৃষ্ণা যেন বাড়িয়া যায়।
বিন্দুকে সেনদিদি একদিন একাই প্রায় তিনঘণ্টা কোণঠাসা করিয়া রাখিল। বাক্যহারা মেয়েটাকে কত কথাই সে যে বলিল তার ঠিকঠকানা নাই। বিন্দু বেশির ভাগ কথার জবাব পর্যন্ত দিল না। তাতে দমিবার পাত্রী সেনদিদি নয়। নিজের প্রশ্ন করিয়া নিজেই একটা পছন্দসই জবাব আবিষ্কার করিয়া বিন্দুর সম্বন্ধে নিজের কাল্পনিক জ্ঞানকে সে অবাধে আগাইয়া লইয়া গেল। মোট কথাটা দাঁড়াইল এই : নন্দ আর একটা বিবাহ করিয়া বিন্দুকে দেখাইয়া দিয়াছে। নন্দর তাহলে তিনটে বিয়ে হল—না দিদি? কী মানুষ নন্দ, অ্যাঁ? শশী বুকি খবর পেয়ে আনতে গিয়েছিল? তাই তো বলি, হঠাৎ কেন শশী কলকাতা গেল। আমি জানি দিদি তোর এমন অদেষ্ট হয়েছে!
এমনি আবেগপূর্ণ মমতা সেনদিদির কানা চোখ ভরিয়া তাহার অশ্রু টলমল করিতে লাগিল!
কুসুম যেদিন শশীর ঘর দেখিয়া গিয়াছিল তারপরে নির্জনে কুসুমের সঙ্গে শশীর আর দেখা হয় নাই। একদিন ভোরবেলা সেই জানালা দিয়ে কুসুম তাহাকে ডাকিয়া তুলিল। শশী উঠিয়া দ্যাখে গোলাপের সেই চারটিকে আজও কুসুম পায়ের তলে চাপিয়া দাঁড়াইয়াছে। কাটা ফুটিবার ভয়ও কি নাই কুসুমের মনে?
আজও চারাটা মাড়িয়ে দিলে বউ! কত কষ্টে বাঁচিয়েছি সে বার।
ইচ্ছে করেই দিয়েছি ছোটোবাবু, চারার জন্যে এত মায়া কেন? দরকার আছে, তবু ডাকতে আসতে হবে,-রাগ হয় না মানুষের?
শশী বলিল, কী দরকার বউ?
কুসুম বলিল, তালপুকুরে আসুন একবার, বলছি।
শশী তালপুকুরে গেল। কনকনে শীতে তালগাছগুলি পর্যন্ত যেন অসাড় হইয়া গিয়াছে। পুকুরের অনেকখানি উত্তরে একটা তালগাছ মাটিতে পড়িয়াছিল, শশীকে কুসুম সেইখানে লইয়া গেল। নিজে তালগাছের গুড়িটাতে জাকিয়া বসিয়া হুকুম দিয়া বলিল, বসুন ছোটোবাবু, অনেক কথা, সময় নেবে বলতে।
শশী কিছু বলিল না। কুসুমের অনেকখানি তফাতে বসিল। কুসুম যেন একটু অবাক হইয়া গেল প্রথমে, তারপর হঠাৎ লজ্জায় মুখখানা তাহার লাল হইয়া উঠিল; বিন্দুর ব্যাপারটা শুনিবার জন্য কুসুম শশীকে এখানে ডাকিয়া আনিয়াছে। কৌতুহলের বশে এতক্ষণ তাহার খেয়ালও হয় নাই যে চুপিচুপি শশীকে এখানে ডাকিয়া আনিলে কতখানি উপযাচিকা অভিসারিকার মতো কাজ করা হয়।
তারপর বিন্দুর কথা জিজ্ঞাসা করিয়া কুসুম শশীকে একটু অবাক করিয়া দিল। খেয়ালি কম নয় কুসুম। বিন্দুর কাহিনী শুনিবার জন্য এত কাণ্ড! ও-কথা সে তো যেখানে খুশি বলিতে পারিত কুসুমকে!
ওর কথা শুনে কী করবে বউ?
কুসুম সবিস্ময়ে বলিল, আমাকে বলবেন না?
শশীর গোপন কথা কুসুমকে না-বলার মতো সৃষ্টিছাড়া ঘটনা যেন আর নেই। জীবনে আজ প্রথম শশী কুসুমের প্রকৃতির একটা আশ্চর্য দিক আবিষ্কার করিয়া অভিভূত হইয়া গেল। একটি বালিকা আছে কুসুমের মধ্যে, মতির চেয়েও যে সরল, মতির চেয়েও নির্বোধ। সংসারকে দেখিয়া শুনিয়া কুসুমের যে-অংশটা বড় হইয়াছে, এই বালিকা কুসুমটি তার আড়ালে বাস করে। সংসারকে যখন সে ভুলিয়া যায়, জীবনের যত দায়িত্ব, যত জটিলতা আছে, কিছুই যখন তাহার নাগাল পায় না, তখন তাহার এই বিস্ময়কর দিকটা চোখে পড়ে। শশী বুঝিতে পারে, এতকাল কুসুমের যেসব পাগলামি সে লক্ষ্য করিয়াছে,-ওর শান্ত সহিষ্ণু ও গম্ভীর প্রকৃতির সঙ্গে যা কোনোদিন খাপ খাওয়ানো যায় নাই –সেসব বহু দূর-অতীতের ছেলেমানুষ কুসুমের কীর্তি-কুসুমের এখনকার পরিণত দেহমনে যার অস্তিত্ব কল্পনা করাও কঠিন।
বিন্দুর কথা ধীরে ধীরে শশী সব বলিয়া গেল। বলিতে বলিতে সে অন্যমনস্কও হইয়া গেল মাঝে মাঝে। কী রহস্যময়ী আজ তাহার মনে হইতেছে কুসুমকে। কুসুম যখন সেদিন দুপুরে তার ঘর দেখিতে গিয়াছিল, সেদিন প্রথম সে লক্ষ করিয়াছে, সব তাহার মন ভুলানোর জন্য বয়স্কা রমণীর প্রণয়-ব্যবহার। বড় দুঃখ হইয়াছিল সেদিন শশীর নিজের মনকে সে মহার্ঘ মনে করে, সে মন যেন বিকাইয়া গিয়াছিল কানাকড়ির দামে। শশী এখন তৃপ্তি বোধ করিল। তাই যদি হইত, কুসুমের সংস্পর্শে সে বছরের পর বছর কাটাইয়া দিয়াছিল, একদিনও সে কি টের পাইত না কুসুম কী চায়? একটি নারী মন জুলাইতে চাহিতেছে এটুকু বুঝিতে কি সাতবছর সময় লাগে মানুষের? এই কুসুমের মধ্যে যে কুসুম কিশোর-বয়সী, সে শুধু খেলা করিত শশীর সঙ্গে। শশী তো চিনিত না, তাই ভাবিত, এত বয়সে পাগলামি গেল না কুসুমের।