শশী বলিল, এর মধ্যে তোর খোকা-খুকি কিছু হয়নি বিন্দু?
বিন্দু ঘাড় নাড়িল। কিন্তু মুখে বলিল উলটা কথা।
মরে গেল যে!
মরে গেল? কবে মরে গেল?
আর বছর।
শেষবার দেখিতে আসিয়া শশীর মনে হইয়াছিল বিন্দুর বোধ হয় ছেলে হইবে। সে ছেলে হইয়া তবে মরিয়া গিয়াছে? বিন্দু দেওয়ালের গাঁয়ে রাধাকৃষ্ণের ছবিটার দিকে চাহিয়া দাঁড়াইয়া ছিল। হঠাৎ শশীর মনে হইল শরীরটা বিন্দুর ঠিক আছে, কিন্তু মুখটা তাহার কেমন এক অদ্ভুত রকমের রোগাহইয়া গিয়াছে। মুখের চামড়ার নিচেই যেন শুষ্কতা,–ত্বকের লাবণ্য শুষিয়া লইতেছে।
তোর অসুখবিসুখ করেছে নাকি বিন্দু?
কিসের অসুখ? বেশ আছি আমি।
বাহিরে গিয়া বিন্দু কোথা হইতে একপাক ঘুরিয়া আসিল।
ভালোই আছিস বিন্দু, অ্যাঁ?
আছি বইকী!
সমস্ত ব্যাপারটা এমন বিস্ময়কর লাগে! এমন রহস্যময় মনে হয় বিন্দুর মুখের গোপন-করা বুড়োটে ভাব, বিন্দুর অবসারক্লিষ্ট, নিরুত্তেজ কথা। বিন্দু তার বোন, পাতানো সম্পর্ক নয়। ছুরি দিয়া আঙুল কাটিয়া দিলে দুজনের যে রক্ত বাহির হইবে তাহা এক, কোনো পার্থক্য নেই। অথচ বিন্দুকে সে একরকম চেনে না, বোঝে না।
শশী মমতার সঙ্গে বলিল, অত দূর বসলি যে এদিকে আয়, এখানে বোস।
বিন্দু উদ্ধতভাবে বলিল, কেন?
শশী বলিল, আয়, সরে আয়, কটা কথা শুধোই তোকে।
ইতস্তত করিয়া বিন্দু কাছে আসিল। তার দুচোখ দিয়া জল পড়িতেছে।
কাঁদিস কেন?
এ প্রশ্নে বিন্দু ফুঁপাইয়া কাঁদিয়া উঠিল।
কোনোদিন তুমি আমাকে কাছে ডেকেছ! কেউ ডেকেছে!
শশী অবাক হইয়া যায়। কিন্তু বলিতে পারে না। এ বাড়িতে আসিয়া পরের মতো আধঘণ্টা বলিয়া সে চিরদিন বিদায় লইয়াছে, তা সত্য। কিন্তু কী করিতে পারিত শশী? কদাচিৎ অতটুকু সময়ের জন্য সে যে আসিত, তাতেই নন্দ পাছে রাগ করিয়া বিন্দুকে কষ্ট দেয় শশীর সেজন্য ভয় করিত। বিন্দুর মনে তাতে এত ব্যথা লাগিত সেই নিরুপায় অনাদরে? বিন্দু তো কোনোদিন কিছু বলে নাই মুখ ফুটিয়া।
অনেক দিনের অভিমানে বিন্দু অনেকক্ষণ কাঁদিল। শেষে সে শান্ত হইল, শশী বলিল, তোর ব্যাপারটা খুলে বল তো বিন্দু?
কিছু না দাদা।
শশী বুঝাইয়া বলিল, আজ না বললে আর কোনোদিন বলতে পারবি না বিন্দুঅন্যদিন লজ্জা করবে। নন্দ খারাপ ব্যবহার করে?
হুঁ। আমাকে ভীষণ শাস্তি দিচ্ছে।
ভীষণ শাস্তি? নন্দ ভীষণ শাস্তি দিতেছে বিন্দুকে? বিন্দুর এমন বাড়ি, এত কাপড়গয়না, এত বিলাসিতার ব্যবস্থা!
হু। তোকে ভালোবাসে না, বিন্দু? বাসে–স্ত্রীর মতো নয়–রক্ষিতার মতো।
অ্যাঁ? কিসের মতো?–শশী যেন বুঝিতে পারে। গাওদিয়ার বিন্দুকে গ্রাসকরা কলিকাতার অনামী-রহস্য শশীর কাছে স্বচ্ছ হইয়া আসে।
বিন্দু বলিল, দেখবে? উনি এলে কোনো ঘরে বসেন দেখবে দাদা? চলো দেখাই।
কী সে তীব্র আলো! গোটা-তিনেক বালব ঘিরিয়া কাচের ঝাড় ঝলমল করে-শশীর চোখ যেন ঝলসিয়া গেল। দেওয়ালে আট-দশটা অশ্লীল ছবি। মেঝে জুড়িয়া ফরাশ পাতা। তাতে কয়েকটা বড় বড় তাকিয়া। হারমোনিয়াম, বাঁয়া তবলা এসবও আছে।
বিন্দু বলিল, গান শিখিয়েছেন। উনি তবলা বাজান, আমি গান করি।
শশীর আর কিছু দেখিবার অথবা শুনিবার ইচ্ছা ছিল না। সে মড়ার মতো বলিল, ওঘরে চল বিন্দু।
বিন্দু শক্ত করিয়া তাহার হাত চাপিয়া ধরিয়া বলিল, না, আসল জিনিস দেখে যাও।
ঘরে ছোটো একটি আলমারি ছিল। টানিয়া দরজা খুলিয়া বিন্দু বলিল, দ্যাখো।
শশী না-দেখিয়াই অনুমান করিয়াছিল। আলমারির তাকগুলি নানা আকারের নানা লেবেলের বোতলে বোঝাই হইয়া আছে।
নিজেকে শশীর অসুস্থ মনে হইতেছিল। এমন কান্ডও ঘটে সংসারে? কত শক্ত মেয়ে বিন্দু! এতকাল একথা সে চাপিয়া রাখিয়াছিল? ছেলে হইয়া মরিয়া না গেলে, স্নেহ করিয়া কাছে না ডাকিলে, আজও হয়তো সে কিছু বলিত না।
তুই খাস?
না খেলে ছাড়ছে কে দাদা? দ্যাখো, আমার একটা দাঁত বাঁধানো–প্রথম দিন সাড়াশি দিয়ে দাঁত ফাঁক করে গলায় ঢেলে দিয়েছিল। তার পর থেকে নিজেই খাই।
এদিকের ঘরে আসিয়া শশী বলিল, জোর করে বিয়ে দেবার জন্যে, না?
বিন্দু বলিল, না। আমি হাবভাব দেখিয়ে ভুলিয়েছিলাম বলে।
কিন্তু তা তো তুই করিসনি? তুই তখন কতটুকু!
ও তাই মনে করে দাদা।
বিন্দুর শুষ্ক চোখ এতক্ষণ জ্বলজ্বল করিতেছিল, আবার স্তিমিত সজল হইয়া আসিল। চোখ মুছিয়া বলিল, কেন মিথ্যে তোমায় বললাম।
শশী ভাবিতেছিল, বিন্দুর কথায় চমকাইয়া গেল। এমন হতাশ হইয়া গিয়াছে বিন্দু? ভাবিতে ভাবিতে শশীর মুখ কালো আর কঠিন হইয়া ওঠে। অন্যদিকে চাহিয়া সে জিজ্ঞসা করিল, নন্দ আর কাউকে আনে,–বন্ধুবান্ধব?
বিন্দু বলিল, না না ছি, ও সব বুদ্ধি নেই। যা শাস্তি দেবার নিজেই দেয়। তারপর মৃদুস্বরে আবার বলিল, অসুখ-বিসুখ হলে খুব ভাবে দাদা, সেবাও করে।
শশী অনেকক্ষণ ভাবিল।
আমার সঙ্গে যাবি বিন্দু? বিন্দু উৎসুক হইয়া বলিল, কোথায় যাব তোমার সঙ্গে?
শশী বলিল, কাল আমরা দেশে বলে যাব,–যাবি?
বিন্দু ব্যগ্র হইয়া বলিল, যাব। চলো এখনি বেরিয়ে পড়ি দাদা, হঠাৎ যদি এসে পড়ে?
বিন্দুর যেন এক মিনিটও সবুর সইবে না। এতকাল এখানে সে কেমন করিয়া ছিল কে জানে। গাড়িতে শশী তাহাকে এই কথাই জিজ্ঞাসা করিল।
পথের পাশে সাজানো দোকানের দিকে চোখ রাখিয়া বিন্দু বলিল, ভেবেছিলাম ক্ষমা করবে।
এতকাল পরে এ কী প্রত্যাবর্তন বিন্দুর? গহনা কই, কাপড় কই, মোটবহর কই? গ্রামের লোক অবাক মানিল বিন্দুকে জ্বালাতনও কম করিল না। ব্যাপারটা বুঝিবার জন্য সকলেই উৎসুক। জেরায় জেরায় বাহিরে পুরুষদের এবং ভিতরে মেয়েদের জীবন অতিষ্ঠ হইয়া উঠিল। শশী আর বিন্দু নিজে ছাড়া কেহ কিছু জানিত না, কেহ কিছু জানিতেও পারিল না। তাই মুখে মুখে নানা কথা প্রচারিত হইয়া গেল।