হঠাৎ ওর এত কলকাতা যাওয়ার শখ হল কেন? শশী জিজ্ঞাসা করিল।
পরাণ তা জানে না। মাথা নাড়িয়া জ্ঞানীর মতো সে শুধু বলিল, জানেন ছোটোবাবু, নাই দিয়ে দিয়ে কর্তা ওর মাথাটা খেয়ে গেছে।
নাই তুমিও ওকে কম দাও না পরাণ!
শশী মতিকে বুঝানোর চেষ্টা করিল। বলিল, কী চাস তুই আমাকে বল, কিনে আনব তোর জন্যে–কী করবি মিছামিছি কলকাতা গিয়ে? মতি ভীরু ও শান্ত, শশীর কথা সে চিরকাল মানিয়া আসিয়াছে,–আজ কিন্তু সে কোনো কথা কানে তুলিল না।
শেষে শশী রাগিয়া বলিল, চল তবে চল। তোকে কলকাতায় ফেলে রেখে আমরা চলে আসব। তখন টের পাবি।
নৌকা, স্টিমার, রেল, তবে কলকাতা। সমস্ত পথ মতি অস্থির, উত্তেজিত হইয়া রহিল! কুসুম চারদিক দেখিতে দেখিতে বেড়ানোর আনন্দ উপভোগ করিতে করিতে চলিল, কিন্তু মতির যেন নদীর বুকে, রেলপথের দুধারে দেখিবার কিছু মিলিল না। অতটুকু মেয়ে, জীবনে এই প্রথম দূরদেশে বেড়াইতে চলিয়াছে, চোখের পলকে পথ ফুরাইয়া গন্তব্যস্থানে পৌঁছাইয়া যাওয়ার ভয়টাই ছিল তার পক্ষে স্বাভাবিক, কিন্তু তার একান্ত আগ্রহ দেখা গেল তাড়াতাড়ি কলিকাতায় উপস্থিত হইতে। হয়তো সে ভাবিয়াছিল কলিকাতায় পা দেওয়া মাত্র কুমুদের দেখা মিলিবে,–তাকে শহরে অভ্যররথনা করিয়া লইবে রাজপুত্র প্রবীর!
পথে একবার সে জিজ্ঞাসা করিল, কলকাতায় আমরা কোথায় থাকব ছোটোবাবু? আপনার সেই বন্ধুর বাড়িতে?
শশী বলিল, খুব তাহলে যাত্রা শুনতে পারিস, না? যাত্রা শুনবার লোভে তুই কলকাতায় চলেছিল নাকি মতি? থিয়েটার দেখিস একদিন, দেখাব তোদের–যাত্রার চেয়ে সে ঢের ভালো।
পাঁচ দিন তাহারা কলিকাতায় রহিল। যা-কিছু দেখার ছিল শহরে দেখিয়া বেড়াইল। স্নান করিল গঙ্গায়, পূজা দিল কালীঘাটে, ট্রামে চাপিয়া অকারণে ঘোরাফেরা করিল। কিন্তু কোথায় মতির রাজপুত্র প্রবীর? শশীর সে বন্ধু, এই শহরের কোথাও সে বাস করে। কিন্তু শশী একবার না করিল তার নাম, না আনিল তাকে ডাকিয়া। শহরের অফুরন্ত বিস্ময় অভিভূত করিয়া না রাখিলে মতির দুচোখ ভরিয়া হয়তো জল আসিত। শিয়ালদহের কাছে একটা হোটেলে তাহারা দু-খানা ঘর ভাড়া করিয়াছে-একটা ঘর শশীর একার। একদিন শশী এক ডাক্তার বন্ধুর বাড়ি রাত কাটাইয়া আসিল। রাত্রে উকি দিয়া তার ঘর খালি দেখিয়া মতি ভাবিল শশী তবে নিশ্চয় কুমুদের কাছে গিয়াছে – সকালে দুজনে একসঙ্গে আসিবে। কুমুদ ছাড়া জগতে শশীর আর কোনো বন্ধু আছে বলিয়া মতি জানে না। পরদিন বেলা দশটা বাজিয়া গেল, সকাল হইতে মতি সিড়ি দিয়া হোটেলের সমস্ত লোকের ওঠানামা চাহিয়া দেখিল, কিন্তু শশী অথবা কুমুদ কেহই আসিল না। পরাণের সঙ্গে সেদিন তাহার জাদুঘরে যাওয়ার কথা,-সকাল সকাল খাওয়াদাওয়া সারিয়া বাহির হওয়া দরকার,-মতি নড়িতে চায় না।
ছোটোবাবু আসুক?
ছোটোবাবু এবেলা আসবে না মতি, এলে এতক্ষণ আসত।
ওবেলা জাদুঘর যাব দাদা, অ্যাঁ? এবেলা বড্ড শীত।
পরাণের চাদরটা গায়ে জড়াইয়া মতি ঠিরঠির করিয়া শীতে কাঁপে।
কুসুম বলে, মর তুই আহ্লাদী মেয়ে ছোটোবাবু আজ মটরগাড়ি চাপাবে না লো, পিত্যেশ করে থেকে করবি কী? দেরি হল বলে মটর এল সেদিন, মটরে ঢের পয়সা লাগে। নাইবি তো নেয়ে ফ্যাল মতি, নয়তো ভাত দিয়েছি খাবি আয়।
যাইতে হইল মতিকে। জন্তু-জানোয়ার দেখিয়া সন্ধ্যার সময় হোটেলে ফিরিয়া সে দেখিল, ঘরে বসিয়া শশী চা খাইতেছে-একা। কুমুদ নিশ্চয় আসিয়াছিল, বসিয়া বসিয়া বিরক্ত হইয়া চলিয়া গিয়াছে।
মতি সভয়ে জিজ্ঞাসা করিল, কখন এলেন ছোটোবাবু?
শশী বলিল, এই তো এলাম খনিক আগে। কোথায় গিয়েছিলি-জাদুঘর? কাল কিন্তু শেষ দিন মতি, পরশু আমরা ফিরে যাব।
মতির তাতে কোনো আপত্তি নাই। আর কলিকাতায় থাকিয়া কী হইবে?
পরদিন সন্ধ্যার সময় শশী বিন্দুর খবর আনিতে গেল। নন্দ থাকিলে রাগ করিবে, হয়তো অপমানও করিবে। করুক। সেজন্য বোনটা বাঁচিয়া আছে কি না এইটুকু না জানিয়া বাড়ি ফেরা যায় না। গোপালের খেয়ালে জীবনে যারা দুঃখ পাইয়াছে তাদের জন্য শশীর মনে একটা অতিরিক্ত মমতা আছে। গোপালের কীর্তিতে নিজেকেও সে কেমন অপরাধী মনে করে। মনে হয়, তারও যেন দায়িত্ব ছিল।
পাড়াটা ভালো নয়। সে পথের শেষাশেষি বিন্দুর বাড়ি-সন্ধ্যার পর মানুষকে সে পথে হাঁটিতে দেখিলে চেনা লোক নিন্দা রটায়। তবে বিন্দুর বাড়িটা একটু তফাতে,– ভদ্রপাড়ার গাঁ ঘেষিয়া! বাড়ির পুবদিকে খানিকটা জমি খালে পড়িয়া আছে। ইট-সুরকির তলে সমাধি পাওয়া বিন্দু বোধহয় ওইদিকে চাহিয়া মাঝে মাঝে অবরুদ্ধ নিশ্বাস ত্যাগ করে।
বিন্দু বাড়ি ছিল না। বিন্দুকে শশী প্রায় আড়াই বছর পরে দেখিল। প্রায় তেমনি আছে বিন্দু। বিন্দুর ঘরের চেহারাও বিশেষ বদলায় নাই।
কেমন আছিস বিন্দু?
ভালো আছি দাদা, কবে এলে? সবাই ভালো আছে তো?
শশী হাসিয়া বলিল, কেন? চিঠি লিখে খবর নিতে পারিস না?
বিন্দু বলিল, চিঠি লিখতে বড় আলসেমি লাগে দাদা!
শশী জানে এটা ফাঁকির কথা। নন্দ চিঠি লিখতে দেয় না। শশীকে খাবার দিয়া নানাকথা জিজ্ঞাসা করিতে লাগিল। গাওদিয়া গ্রামটি সম্বন্ধে আজও বিন্দুর কৌতুহল আছে। কে বাঁচিয়া আছে, কে স্বর্গে গিয়াছে, চেনা ছেলেমেয়েদের মধ্যে কার কার বিবাহ হইয়াছে, কার কটি ছেলেমেয়ে–শশীর মুখে এসব খবর শুনিতে শুনিতে বিন্দুর চোখ ছলছল করিতে লাগিল।