ছোট বোন সিন্ধু আর মতি ছাড়া কারো সঙ্গে শশীর ভালো লাগে না। এতবড় গ্রামে শুধু এই দুটি প্রিয়তমা বান্ধবী। নিচে সিন্ধু পুতুলখেলা করে, খাটে বসিয়া শশী অস্বাভাবিক মনোযোগের সঙ্গে সে খেলা চাহিয়া দ্যাখে।
খুকী, বড় হইয়া তুই কী করবি?
পুতুল খেলব।
এই একটিমাত্র জবাবে ক্ষণেকের জন্য শশীর মন যেন একেভাবে হালকা হইয়া যায়। জানালা দিয়া সে বাহিরের দিকে তাকায়। জানালার নিচে সেদিন কুসুম যে গোলাপের চারটি মাড়াইয়া দিয়াছিল, শশীর যত্নে সেটি আবার মাথা তুলিয়াছে।
মতি স্পষ্টই জিজ্ঞাসা করে, আপনার সেই বন্ধুটি পত্ৰ দিয়াছে?
কে রে মতি, কুমুদ? না দেয়নি—কেন?
এমনি শুধোচ্ছি।
সুন্দর যাত্রা করে যে!
তা বটে। সুন্দর যাত্রা করে বলিয়া কুমুদ পত্ৰ দিয়াছে কি না মতির তা জিজ্ঞাসা করা চলে বটে। শশী হাসিয়া বলে, ওর পার্ট তোর খুব ভালো লাগত, না রে মতি?
আমার একার কেন, সবার লাগত। একটা যাত্রাগান দিন না ছোটোবাবু, দেবেন? কত টাকা নেয়? গম্ভীরমুখে শশীর হাসিকে মতি অগ্রাহ্য করে, বলে, আমার টাকা থাকলে দলটা ভাড়া করে আনতাম ছোটোবাবু, আমাদের বাড়ির সামনে শামিয়ানা খেঁচে আসর করে দিতাম, পালা হত সাত দিন।
মতি একটু গম্ভীর হইয়াছে আজকাল। কথা বলিতে বলিতে দুচোখে তাহার একটু ভীরু ঔৎসুক্য দেখা দেয়। কথা শেষ করিয়া কী যেন ভাবে মতি। শশী ভাবে , কে জানে, হয়তো ধীরে ধরে অবশ্যম্ভাবী আত্মচিন্তাই এবার আসিতেছে মতির। গ্রামের মেয়ে তো, নিশ্চিন্ত থাকিবার বয়সটা ইতিমধ্যে পার হইয়া যাইতে আরম্ভ করিবে আশ্চর্য নাই।
একদিন বাসুদেব বাঁড়ুজ্যে সপরিবারে গ্রামত্যাগের আয়োজন করিলেন। কলিকাতায় মেজছেলে চাকরি করিত, সম্প্রতি সেজছেলেরও কোনো আফিসে চাকুরি হইয়াছে। জমিজমা নাই। গোপালের শক্রতার জন্য কেহ টাকা ধার করিতে আসে না। আসিলেও গোপালের পরামর্শে সুদে-আসলে গাপ করিতে চায়। ম্যালেরিয়ায় ভুগিতে আর কেন গ্রামে থাকা? এমন অনেক গিয়াছে। গ্রাম জুড়িয়া এখানে-ওখানে পোড়ো ভিটা খাঁ-খাঁ করে। খবর পাইয়া শশী দেখা করিতে গেল; জিনিসপত্র বাধাছাদা হইতেছে দেখিয়া হঠাৎ কেমন রাগ হইয়া গেল শশীর। সে নিজে যখন গ্রামের পাঁকে আত্মসমর্পণ করিয়াছে চিরকালের জন্য, আর কারো যেন গ্রাম ত্যাগ করা অন্যায়।
আপনার কাছে কতগুলো টাকা পেতাম বাঁড়ুয্যেকাকা।
কলকাতায় গিয়া পাঠিয়ে দেব বাবা। কটা টাকা তো–ছেলেরা মাসকাবারের মাইনে পেলে একটা দিনও দেরি করব না।
শশী মাথা নাড়িল, না, অনেকদিন পড়ে আছে টাকাটা, দিয়েই যান!
শশীর এত টাকার প্রয়োজন কিসের কে জানে বিশ্রী একটা কলহ বাঁধিয়া গেল বাসুদেবের সঙ্গে। তার দুই ছেলে রুখিয়া আসিল। কোনো পক্ষেরই মানঅপমানের পার্থক্য রহিল না। তবু শশী ছাড়িল না-ছোট নোটবুকটিতে ভিজিট আর ওষুধের জন্য যত টাকার অঙ্কপাত করা ছিল, সমস্ত টাকা আদায় করিয়া ক্ষান্ত হইল। টাকাটা পকেটে পুরিয়া বলিল, দু দুটো চাকরে ছেলে আপনার,–ডাক্তারের ফি দিতে মরেন কেন বাঁড়ুয্যেকাকা? কলকাতায় ডাক্তার দেখে তার সঙ্গে যে এ রকম করবেন না কখনও, জুতো মেরে যাবে।
ফিরতে ইচ্ছা হয় না শশীর,-অনেকক্ষণ ধরিয়া আরও তীব্র ভাষায় সকলকে গালাগালি দিতে ইচ্ছা হয়, সে একটা কটু আনন্দের নিবিড় স্বাদ পায়। বাসুদেবের বিধবা বউটি, মৃত ভুতোকে বাঁচানোর জন্য একদিন যে শশীর পথ আটকাইয়াছিল, হঠাৎ তার দিকে চোখ পড়ায় শশী যেন চমকাইয়া গেল। ভূতোর মৃত্যুর তিন মাস পরেও এ-বাড়ির কাছাকাছি পথ দিয়া যাওয়ার সময় শশী এর বিনানো কান্না শুনিয়াছে। আজও সে কাঁদিতেছিল, নিঃশব্দে। আশ্চর্য নয়, যার চিকিৎসায় ভুতো বাঁচে নাই, সেই ডাক্তার আসিয়া ভিজিটের টাকার জন্য এমন কান্ড করিলে মন যার স্নেহকোমল সে তো কাঁদিবেই। পাংশুমুখে শশী পলাইয়া আসিল।
ভূতোর চিকিৎসার হিসাব যে সে ধরে নাই,-যে টাকা সে আদায় করিয়াছে তার প্রত্যেকটি পয়সা যে এ-বাড়ির জন্য লোকের অসুখের চিকিৎসা করার দরুন,–যারা আজও সুস্থ শরীরে বাঁচিয়া আছে, বউটি একবারও তাহা ভাবিবে না। ভূতোর জন্য মন কেমন করিলে গাওদিয়ার শশী ডাক্তারকে স্মরণ করিয়া সে শিহরিয়া উঠিবে। হয়তো কোনোদিন শহরের প্রতিবেশিনীদের কাছে গ্রামের গল্প বলিবার সময় আজিকার ঘটনার উল্লেখ করিয়া বলিবে, গাঁয়ের ডাক্তারগুলো পর্যন্ত এমনি মানুষ দিদি, আমরা গাঁ ছেড়ে এসেছি কি সাধে?
কয়েক দিন পরে শশীর একবার কলিকাতা যাওয়ার প্রয়োজন ছিল,— কয়েকখানা বই ও কতগুলি ওষুধ কিনিবে। একদিন পরাণ লজ্জিত মুখে কাছে আসিয়া দাঁড়াইল, বলিল, কলকাতা যাবার বায়না নিয়ে মতি বড়ো কাঁদা-কাটা জুড়েছে ছোটোবাবু।
শশী অবাক হইয়া বলিল, কলকাতা যাবে? কার সঙ্গে?
বলছে আপনার সঙ্গে যাবে।
শশী হাসিয়া বলিল, তুমি বুঝি তাই আমাকে বলতে এসেছ, যদি নিয়ে যাই? তোমার বুদ্ধি নেই পরাণ। আমি যেতে পারি নিয়ে,–গাঁয়ের লোক বলবে কী?
শশী একা মতিকে লইয়া কলিকাতা যাইবে, পরাণ সেকথা বলিতে আসে নাই। পরাণও সঙ্গে যাইবে বইকী। মোক্ষদা বারকয়েক গঙ্গায়ানের ইঙ্গিত করিয়াছে,-এ সুযোগ বুড়ি ছাড়িবে মনে হয় না। সুতরাং কুসুমও যাইবে সন্দেহ নাই। মতির জন্য এবার ফতুর হইতে হইবে পরাণকে,-এতগুলি মানুষের কলিকাতা যাওয়া-আসার খরচ কি সহজ। কিন্তু না-গেলেও চলিবে না,-মতি দুদিন নাওয়া-খাওয়া ছাড়িয়া কাঁদিয়াছে।