গোপালের রাগ হয়। সে যামিনীকে বলে, কী শুনছি খুড়ো? ছেলের নিন্দে কেন?
কার নিন্দে? শশীর? যামিনী আশ্চর্য হইয়া যায়, আমি শশীর নিন্দে করব। একথা তোর বিশ্বাস হয় গোপাল?
ঘরে নিন্দে কর, আমার কাছে নিন্দে করো, কথা নেই। কিন্তু খবৰ্দার বাইরে যেন নিন্দে কোরো না খুড়ো।
কিন্তু যামিনী নিজেকে মিলাইতে পারে না। তাহার অসহ্য জ্বালা। সে ফের শশীর নিন্দা করিয়া বসে।
বলে, গীটাকে ও ছোড়া উচ্ছন্ন দেবে। ছোড়ার চুল ছাঁটার কায়দা দেখেছিস!
মাঝে মাঝে শশীকেও সে অপমান করে, শশী গায়ে মাখে না। আগে শশী কারো অপমান সহ্য করিত না, আজকাল তাহার একপ্রকার অদ্ভুত ধৈর্য আসিয়াছে। যামিনীর কথায় তাহার একেবারেই রাগ হয় না। সেনদিদির অসুখ উপলক্ষে ওর যে পরিচয় সে পাইয়াছে তাহাতে বুঝিতে তাহার বাকি থাকে নাই যে, সংসারের বন্ধ পাগল ছাড়াও কমবেশি অনেক পাগল আছে। এক-এক বিষয়ে মাথায় যাহাদের অত্যাশ্চর্য বিকার থাকে। যামিনীও তাহাদেরই একজন। ওর অর্থহীন অপমানে রাগ করিলে নিজে সে এমনি পাগলের দলে গিয়া পড়িবে।
তা ছাড়া, আর-এক দিক দিয়া শশীর মন শাস্ত হইয়া স্থিতিলাভ করিয়াছিল। তাহার ইনটেলেকচুয়াল রোমান্সের পিপাসা। যাহা চায়ের ধোয়ার মতো, জলীয় বাষ্প ছাড়া আর কিছু নয়, চা-ও নয়। জীবনকে দেখিতে শিখিয়া, অত্যন্ত অসম্পূর্ণ ভাসা-ভাসা ভাবে জীবনকে দেখিতে শিখিয়া, সে অবাক হইয়া দেখিয়াছে যে এইখানে, এই ডোবা আর জঙ্গল আর মশাভরা গ্রামে জীবন কম গভীর নয়, কম জটিল নয়। একান্ত অনিচ্ছার সঙ্গে গ্রামে ডাক্তারি শুরু করিয়া ক্রমে ক্রমে এ জীবন শশীর যে ভালো লাগিতেছে, ইহাই তাহার প্রথম ও প্রধান কারণ। তারপর যাত্ৰাদলের অভিনেতা সাজিয়া কুমুদের আবির্ভাব। মোনালিসার কুমুদ, ভেনাস ও কিউপিডের কুমুদ, শেলি-বায়রন-হুইটম্যানের কুমুদ, পেগ খাওয়া waltz-foxrot-নাচা কুমুদ, নীলাক্ষীর প্রেমিক কুমুদ, তার চেয়ে বয়সে জ্ঞানে বিদ্যায় বুদ্ধিতে শ্রেষ্ঠ কুমুদ; যাত্ৰাদলের অভিনেতা সাজিয়া তাহার আবির্ভাব! এ কি ব্যর্থ যায়! শশীর মন শাস্ত হইয়াছে, স্থিতিলাভ করিয়াছে। কেমন করিয়া হঠাৎ সে বুঝিতে পারিয়াছে কিডস্কিনের জুতাটা, আশ্চর্য শাড়িটা, বিস্ময়কর ব্লাউজটাই আসল। আর আসল তখনকার কুমুদের টাকাটা। তারপর তোমার চেহারা তো আছেই! সেটাও একটু দরকার আর দরকার বিশ্বজগৎকে একটু ডোন্ট কেয়ার করার ভাব। জমিল রোমান্স।
শশী এটা বুঝিয়াছে। কিন্তু হিসাব তো কম নয়? অতগুলি সমস্বয় তো তুচ্ছ নয়? এটাও শশী স্বীকার করে। স্বীকার করে যে ব্যাপারটা মন্দ নয়। মানুষের সভ্যতার খুবই অগ্রগতির পরিচয়, চমৎকার উপভোগ। লোভ করিবার মতো। পাইলে সে লাভবানই হইত। কিন্ত বঞ্চিত হইয়াছে বলিয়া মনের মধ্যে অসন্তোষ পুষিয়া রাখিবার মতোও কিছু নয়।
শশী ইহাও বুঝিয়াছে যে, জীবনকে শ্রদ্ধা না করিলে জীবন আনন্দ দেয় না। শ্রদ্ধার সঙ্গে আনন্দের বিনিময়, জীবনদেবতার এই রীতি।
শশী তাই প্রাণপণে জীবনকে শ্রদ্ধা করে। সংকীর্ণ জীবন, মলিন জীবন, দুর্বল পঙ্গু জীবন- সমস্ত জীবনকে। নিজের জীবনকে সে শ্রদ্ধা করে সকলের চেয়ে বেশি।
কুসুমের সঙ্গে কিন্তু শশীর আর একদিন ঝগড়া ইহয়া গিয়াছে।
রাত্রে একদিন হঠাৎ কুসুমের পেটের ব্যথা ধরিয়াছিল। অসহ্য প্রাণঘাতী ব্যথা। শশীকে না ডাকিয়া উপায় ছিল না। রাত্রে, বিশেষত শীতের রাত্রে, ঘুম ভাঙিয়া বিছানা ছাড়িয়া উঠিয়া গিয়া ডাক্তারি করাটা শশীর এখনো ভালোরকম অভ্যাস হয় নাই। প্রথমে সে একটু বিরক্তই হইয়াছিল। পেটে ব্যথা পেটে ব্যথার জন্য হারু ঘোষের বংশে কবে ডাক্তার ডাকিয়াছে? একটু গরম তেল মালিশ করিয়া দিলেই হইত। কিন্তু কুসুমের ব্যথার প্রতাপ দেখিয়া শশীর বিরক্তি টেকে নাই।
কলিক? কে জানে?
কী খেয়েছিলে পরাণের বউ?
জবাব দিয়াছিল মতি।
বে আজ কিছু খায়নি ছোটোবাবু। দাদার সঙ্গে ঝগড়া করে সারাদিন উপোস করেছে। একাদশীর দিনে এয়োস্ত্রী মানুষ করল উপোস,–হবে না?
কথাটা সাংঘাতিক। একাদশীর দিন এই উপবাস করার কথাটা। এমন কাজ করিবার মতো বুকের পাট কুসুম ছাড়া আর কারো হইত কি না সন্দেহ।
কিছু খাওনি পরাণের বউ?
খেয়েছি। খাব না কেন? একটা মাছের আঁশ খেয়েছি। কুসুম ধুঁকিতে ধুঁকিতে বলিয়াছিল।
তাহা হইলে একাদশীর দিন উপবাস করে নাই। ঝগড়ার কথাটাই সত্য, একাদশীর উল্লেখট মতি অনর্থক করিয়াছে। শশীর হঠাৎ রাগ হইয়া গিয়াছিল। কেন, কী বৃত্তান্ত না জানিয়ে মতি অমন যা-তা মন্তব্য করে কেন? কিন্তু কুসুমের কী হইয়াছে? কলিক? পেটের ব্যথাটা বড় রহস্যময় অসুখ। পরীক্ষা করিয়া দেখিবার উপায় নাই, সত্য কি মিথ্যা বুঝিবার উপায় নাই, থার্মেমিটার স্টেথোস্কোপ কোনোটাই কাজে লাগে নাই। রোগী যা বলে তা-ই সই। ব্যথাটা ডানদিকে বলিলে ডানদিকে, ঝিলিক দেওয়া ব্যথা বলিলে ঝিলিক-দেওয়া ব্যথা, চনচনে একটানা ব্যথা বলিলে চনচনে একটানা ব্যথা। সন্দেহ করিবার যো নাই। কুসমের বর্ণনা শুনিয়া শশী কিছুই বুঝিতে পারে নাই। পরাণকে সে আড়ালে ডাকিয়া লইয়া গিয়াছিল।
খানিক পরে বাড়ি গিয়া পাঠাইয়া দিয়াছিল ওষুধ। নিজে আর ফিরিয়া যায় নাই।
এই হইল তাহার অপরাধ। পরদিন খবর লইতে গিয়া দেখে কুসুম আগুন হইয়া আছে।
মরিনি। এই আপনার টাকা।
কুসুম সত্য সত্যই আঁচলে বাধা দুটি টাকা শশীর সামনে রাখিল। শশীর বুঝিতে বাকি রহিল না এই উদ্দেশ্যেই সে আচলে টাকা বাঁধিয়া ঘরের কাজ করিতেছিল।