একটি কথা নয়। বাহিরের ঘরে ফরাশের উপর খাতাপত্র ছড়াইয়া বসিয়া গোপাল হিসাব দেখে,-খাতক, ঋণপ্রার্থী, পরামর্শপ্রার্থী ও অনুগ্রহপ্রার্থীদের সঙ্গে কথা বলে। শশী ঘরের ভিতর দিয়া পার হইয়া যাইবার সময় গোপাল হঠাৎ কথা বন্ধ করিয়া আড়চোখে ছেলের দিকে তাকায়। কথা বলিবে না, না বলুক, ছেলেকে গলার আওয়াজও সে শুনাইবে না কি? তা-নয়। শশীকে দেখলে গোপালের ডাকিতে ইচ্ছ হয়, শশী শোন। এই ইচ্ছাটা দমন করিবার সময় গলা দিয়া গোপালের আওয়াজ বাহির হয় না। গোপাল বাক্যহারা হইয়া থাকে।
শশী বাহির হইয়া গেলে অনুগ্রহপ্রার্থীকে বলে, শুধিয়ে এসো তো যাচ্ছে কোথায়?
সে যদি আসিয়া বলে,-যামিনী কবিরাজের বাড়ি-গোপাল একদম খেপিয়া যায়।
ইয়ারকি? ইয়ারকি হচ্ছে আমার সঙ্গে?
অনুগ্রহপ্রার্থীর চোখে আর পলক পড়ে না।
যামিনী কবিরাজের বউ-এর গুটিগুলি শুকাইয়া ঝরিয়া পড়িতে কাতিক মাস কাবার হইয়া অগ্রহায়ণেরও কয়েক দিন গিয়াছে। তাহকে দেখিলে এখন ভয় করে, করুণা হয়। সর্বাঙ্গের ছোট ছোট ক্ষতগুলি এখনো লালচে রঙের কদর্য কতকগুলি গর্ত। সময়ে বারকয়েক চুমটি পড়িয়া পড়িয়া ক্ষতের কতক দাগ অনেকটা মিলিয়া আসিবে, কতক থাকিবে। কিন্তু যামিনী কবিরাজের বউ-এর রূপের খ্যাতি আর রহিল না। রূপই গেল নষ্ট হইয়া, রূপের খ্যাতি!
একটা চোখও তার নষ্ট হইয়া গিয়াছে।
এই ক্ষতিটাই যামিনী কবিরাজের বউকে কাবু করিয়াছে সবচেয়ে বেশি। শুধু ক্ষতচিহ্নে ভরিয়া রূপনষ্ট হওয়াটাও তাহার কাছে সহজ ব্যাপার নয়। রূপ তাহার তেত্রিশ বছরের আত্নীয়, তেত্রিশ বছরের আভ্যাস। একগোছা চুল কাটিতে মেয়েরা কাতর হয়, এ তো তাহার সর্বাঙ্গণ সৌন্দর্য, আসল সম্পত্তি। তবু এটা তার সহ্য হইত। মনকে সে এই বলিয়া বুঝাইতে পারিত যে আর কী তাহার ছেলেখেলার বয়স আছে? ছেলে-ভুলানো রূপ দিয়ে এখন সে করিবে কী? কিন্তু চোখ কানা হইয়া যাওয়া! এ তো রূপ নষ্ট হওয়া নয়, এ যে কুৎসিত হওয়া, কদর্য হওয়া! তাহাকে দেখিলে এবার যে লোকের হাসি পাইবে? তাহার অমন ডাগর চোখ!
চোখ নষ্ট হয়ে গেল শশী! আমি কানা হয়ে গেলাম।
কী আর করবেন সেনদিদি? বেঁচে যে উঠেছেন—শশী সান্ত্বনা দেয়।
এর চেয়ে আমার মরাই ভালো ছিল শশী, যামিনী কবিরাজের বউ বলে।
বলে, দেখলে ঘেন্না হয় না?
না না, ঘেন্না হবে কেন? ঘেন্না হয় না।
যামিনী কবিরাজের বউকে দেখিলে শশীর দুঃখ হয়, ঘেন্না হয়তো হয় না। না, ঘেন্না হয় না।
শশী সেরকম নয়।
কিন্তু সেনদিদির দাম যে কমিয়াছে তাতে সন্দেহ নই। শশী অবশ্য বুঝিতে পারে না, সেনদিদির আকর্ষণ যতখানি কমিয়াছে সহানুভূতি দিয়া তাহার ক্ষতিপূরণ হইয়াছে। সেনদিদির হাসি আর দেখিবার মতো নয়, তাহার একটি চোখে এখন আর গভীর স্নেহ রূপ নেয় না, তাহার মুখের দিকে অবাক হইয়া চাহিয়া থাকিবার সাধ্য এখন আর কাহারও নাই। সেনদিদির মুখের কথা, তাহার মেহর ও পক্ষপাতিত্ব আজ আর অমূল্য নয়। তাহার জন্য শশীর দুঃখ হয় কিন্তু শশীকে সে আর তেমনিভাবে টানিতে পারে না।
প্রতিদিন সেনদিদিকে দেখিতে আসার সময় শশী আজকাল পায় না। আসিলেও, বেশিক্ষণ বসিবার তাহার উপায় নাই। যামিনী কবিরাজের বউকে ভালো করিয়া শশীর পসার কয়েক দিনেই বাড়িয়া গিয়াছে। রোগীকে সে আর ফিরাইয়া দেয় না, দেখিতে যায়, পকেটে টাকা লইয়া বাড়ি ফেরে। একটা রাত্রি সে তো নন্দপুরেই কাটাইয়া আসিল। যাতায়াতের খরচ আর দশ টাকা ভিজিট। গ্রামে দশটা রোগী দেখিলে দশ টাকা, এক রাত্রে দশ-দশটা টাকা পাওয়া সহজ কথা নয়।
যামিনী কবিরাজের বউ বলে, সেনদিদিকে ত্যাগ করলে না কি শশী?
না সেনদিদি। রোগীর বড় ভিড়। আসবার সময় পাই না।
আঃ বেঁচে থকো বাবা, তাই হোক। আরও রোগী হোক, লক্ষপতি হও। ভগবানের কাছে দিনরাত এই প্রার্থনা করছি।-যামিনী কবিরাজের বউ যেন কাদিয়া ফেলিবে। রোগা শরীর, আবেগে কান্নাই চলিয়া আসে।-বিয়ে করে সংসারী হও, দেশজুড়ে তোমার নাম হোক, তাই দেখে যেন মরতে পারি।
এক চোখের কোটরে ঢুকানো তাহার একটিমমাত্র ডাগর চোখের নিরতিশয় মোহাচ্ছন্ন সজল দৃষ্টিতে শশীকে সে দেখিতে থাকে। যামিনীর চেলারা ওদিকে হামাদিস্তায় ঠকাঠক শব্দে গুল্ম গুড়া করে। যামিনী খায় তামাক। কাশে আর ভাবে। স্ত্রীর ঘরের চৌকাটও সে ডিঙায় না। শশীর সঙ্গে কথা বলে না। ভাবনার তাহার অম্ভ নাই। থাকার কথাও নয়। এই বয়সে,-বয়স তাহার ষাটের উপর গিয়াছে, মানুষের আর কত সহ্য হয়? কাণ্ড দ্যাখো, এতদিনের রূপসী বউটা এমন কুৎসিত হইয়াই বাঁচিয়া উঠিল যে, চোখে দেখিলে মাথা ঘোরে। ভালো এক আপদ আসিয়া জুটিয়াছিল,–শশী। মানুষকে ও মরিতেও দিবে না?
গ্রামবাসী কিন্তু যামিনীর মুখে অন্য কথা শোনে।
শশীর চিকিৎসা চিকিৎসাই বটে। অমনি চিকিৎসা হলে রুগীকে আর শিগগির শিগগির স্বর্গে যাবার ভাবনা ভাবতে হয় না। মেরেই ফেলেছিল। বসম্ভের চিকিৎসা ও কী জানে? কত ওষুধপত্র দিয়ে আমিই শেষে…
বলে, চোখটা গেল কি সাধে? ওই লক্ষ্মীছাড়ার দু দাগ ওষুধ খেয়ে!
এসব কথা গোপালের কানে যায়। গ্রামের অনেকে গোপালের কাছে গিয়া বলে যে যামিনী কবিরাজ আচ্ছা নিমকহারাম, গোপালের ছেলের নিন্দা করিয়া বেড়াইতেছে। সংবাদটা বলিবার সময় অনেকে মনে মনে হাসে। গ্রামের লোকের অনুমানশক্তি প্রখর। সকালে আকাশের দিকে চাহিয়া তাহারা বলিতে পারে বিকালে বৃষ্টি হইবে। বিকালে যদি নেহাত বৃষ্টি না-ই হয় সে অপরাধ অবশ্য আকাশের। গোপাল যামিনী কবিরাজের বউ আনিয়া দিবার পর গ্রামের লোক চার-পাঁচ বছর ধরিয়া যাহা অনুমান করিয়াছিল তাহা যদি মিথ্যা হয় তবে পৃথিবীই মিথ্যা। অর্থাৎ সে অপরাধ গ্রামের লোকের অনুমানশক্তি ছাড়া জগতের আর সমস্ত কিছুর। তাই, যামিনী কবিরাজ সংক্রান্ত কোনো সংবাদ দিবার সময় গম্ভীর মুখে গোপালের দিকে চাহিয়া মনে মনে তাহারা হাসে।