কুমুদের বুদ্ধি দেখিয়া মতি অবাক হইয়া গিয়াছে।
–অন্য সাপে কামড়ালে মরে যেতাম? আমি মরে গেলে তুমি কী করতে?
আমি? আমি কী করতাম? কী জানি কী করতাম।
কাঁচা মেয়ে। একেবারেই কাঁচা মেয়ে। কিন্তু মনে মনে মতি সবই জানে। কী জানে না সে? সেদিন কুমুদ সাপের কামড়ে মরিয়া গেলে সে কিছুই করিত না এক নম্বর, মতি এটা জানে। দু নম্বর সে জানে, কুমুদ শুনিতে চায় সে মরিয়া গেলে মতি একটু কাদিত। মতি এত কথা জানে! সে কিছু করিত না এই সত্যকথা, আর সে যে একটু কাদিত এই মিথ্যাকথা, এর কোনোটাই যে বলিতে নাই, এও যদি মতি না জানিবে-মধ্যবর্তী ও জবাবটা দিয়া সে অজ্ঞতার ভান করিল কেন? তবু, যত হিসাবই ধরা যাক মতি কাঁচা মেয়েই।
এখন যদি মরে যাই? কুমুদ বলে।
তা হলে আমি–এখন যদি মরে যান? দূর, মরার কথা বলতে নেই।
কে জানে মতি এসব শিখল কোথায়! আপনা হইতে শিখিয়াছে নিশ্চয়কথা বলিতে, কাপড় পরিতে, ভাত খাইতে শেখার মতো। এসব কেহ শেখায় না। কে শিখাইবে? এবং তারপর কুমুদ মতিকে নানা কথা জিজ্ঞাসা করে। আর ছেলেমানুষি প্রশ্ন নয়। তাহার নিজের কথা, অষ্ট্রীয়-স্বজনের কথা, তাহার গ্রামের কথা। মতি আগ্রহের সঙ্গে সকল প্রশ্নের জবাব দেয়। কখনও পালটা প্রশ্ন করে। কখনওবা আপনা হইতেই কুমুদকে অনেক অতিরিক্ত অবান্তর কথা বলে। তাহার সরল চাহনি একবারও কুটিল হইয়া ওঠে না। তাহার নির্ভরশীলতা কখনও টুটিয়া যায় না। না, মতির কোনো ভাবনা নাই। সে কিছু জানে না, কিছু বোঝে না, পৃথিবীর সবই তাহার কাছে অভিনব, অভিজ্ঞতার অতীত। কুমুদকে হাত ধরিতে দেওয়া উচিত কি অনুচিত সে তার কী জানে। ওসব কুমুদ বুঝিবে। রাজপুত্র প্রবীর বুঝিবে। মতির বিশেষ লজ্জাও করে না। তবে, হঠাৎ চোখ নিচু করিয়া একটু যে সে হাসে সেটা কিছু নয়।
দিন ও রাত্রির মধ্যে দুপুরের সময়ের গতি সবচেয়ে শিথিল। দুপুরের অন্ত নাই। আকাশের সূর্য কতক্ষণে কতটুকু সরিয়া তাহদের গায়ে রোদ ফেলেন জানা যায় না। তাহারা উঠিয়া টিলাটার দিকে চলিতে থাকে। ওদিকে নিবিড় ছায়ার ছড়াছড়ি।
০৫. যামিনী কবিরাজের বউ সেনদিদি
যামিনী কবিরাজের বউ বাঁচিয়া উঠিয়াছে। ভগবানের দয়া, যামিনী কবিরাজের বউ-এর কপাল, শশীর গৌরব।
গোপাল ছেলের সঙ্গে আজকাল প্রায় কথা বন্ধ করিয়া দিয়াছে। যামিনী কবিরাজের বউ বাঁচিয়া উঠিয়াছে বলিয়া নয়, অন্য কারণে। অন্য সাধারণ মানুষের তাই ধরিয়ালওয়া উচিত। ব্যাপারটা হইয়াছিল এই। শশীর বেশ পসার হইয়াছে। বাজিতপুরের সরকারি ডাক্তারকে ডাকিতে খরচ অনেক। অনেকে শশীকেই ডাকে। যামিনী কবিরাজের বেএর চিকিৎসার জন্য কয়েকদিন শশী দূরে কোথাও যাওয়া তো বন্ধ রাখিয়াছেই, তিন মাইল দূরের নন্দনপুরের কল পর্যন্ত ফিরাইয়া দিয়াছে। এই সময়টা যামিনী কবিরাজের বউ মরিতে বসিয়াছিল। গোপালের উস্কানিতে যামিনী ঝগড়া করিয়া অপমান করিয়া শশীর আসা-যাওয়া বন্ধ করিবার চেষ্টা করিয়া সফল হয় নাই। দূর গ্রামে রোগী দেখিতে পাঠাইতে না পারিয়া ছেলের উপর গোপাল খেপিয়া গিয়াছে। অথচ বাড়াবাড়ি করিবার সাহস তাহদের ছিল না। শশীকে তাহারা দুজনেই ভয় করিতে শুরু করিয়া দিয়াছিল। মনে পাপ থাকার এই একটা লক্ষণ। মনে হয়, সকলে বুঝি সব জানে। সাপ উঠিয়া পড়ার আশঙ্কায় কেচো খুঁড়িবার চেষ্টাতেও মানুষ ইতস্তত। আকশে চাঁদ উঠে, সূর্য ওঠে। পৃথিবীটা চিরকাল ঈশ্বরের রাজ্য। মানুষের এই বদ্ধমূল সংস্কার সহজে যাইবার নয়। হাজার পাপ করিলেও নয়।
এমনি করে তুমি, গোপাল বলিয়াছিল, পসার রাখবে? লোকে ডাকতে এলে যাবে না? মক্কেল ফিরিয়ে দেব?
বলিয়াছিল, যামিনী খুড়ো কোনোদিন এতটুকু উপকার করবে যে ওর জন্য এত কছ? নিজের সর্বনাশ করে পরের উপকার করে বেড়ানো কোন দেশী বুদ্ধির পরিচয় বাপু?
আমার মার যদি ওমনি অসুখ হত?-শশী বলিয়াছিল। কেন বলিয়াছিল কে জানে!
তোমার মা তো বাপু বেঁচে নেই। কপাল ভালো, তাই আগে আগে ভেগেছেন। তোমার যা সব কীর্তি—যে কীতি সব তোমার; তুই উচ্ছন্ন যাবি শশী।
যামিনী কবিরাজের বউ বাঁচিয়া উঠিবার পর বিপজ্জনক গাম্ভীর্যের সঙ্গে গোপাল বলে, এইবার কাজকর্মে মন দাও শশী। যামিনী খুড়োর ইচ্ছে নয় তুমি ওদের বাড়ি যাও।
ঠাকুর্দাকে পুলিশে দেওয়া উচিত।
সর্বনাশ! শশী এসব বলে কী!
তোমার ইচ্ছেটা কী শুনি? হ্যা রে বাপু, মনের বাসনাটা তোমার কী? সব ছেড়েছুড়ে আমি কাশী চলে গেলে তমি বোধহয় খুশি হও? গুরুদেব তাই বলছিলেন। বলছিলেন, আর কেন গোপাল, এইবার চলে এসো। আমি ভাবছিলাম, শশীর একটু স্থিতি করে দিয়ে যাই, হঠাৎসব ছেড়ে চলে গেল ও কোনদিক সামলাৰে। কিন্তু তুমি এরকম আরম্ভ করলে আর একটা দিনও আমি থাকি কী করে?
গোপাল করিবে সংসার ত্যাগ, গোপাল যাইবে কাশী সম্মুখযুদ্ধ ত্যগ করিয়া পিছন হইতে গোপালের এই ধরনের আকস্মিক আক্রমণ শশীর অভ্যাস হইয়া গিয়াছে। সে এতটুকু টলে না।
কী অন্যায় কাজটা করেছি আমি, তাই বলুন না।
কী করেছ? মুখে চুনকালি মেখেছ। সবাই কী বলছে তোমার কানে যায় না-আমার কানে আসে। যামিনী খুড়োর বউ-এর অসুখে তোমার এত দরদ কেন? ডাক্তার মানুষ তুমি, একবার গেলে, ওষুধ দিলে, চলে এলে। দিনরাত রোগীর কাছে পড়ে থাকলে বলবে না লোকে যে আগে থাকতে কিছু না থাকলে।
এসব আপনার বানানো কথা।
এ অভিযোগ সত্য বলিয়া গোপালের রাগ বাড়িয়া যায়। গোপাল ছেলের সঙ্গে কথা বলে না।