বিমলবাবুর স্ত্রী শুধোন, আমার মুখে কী দেখছ বাছা?
বিলিবাবুর মেয়ে বলে, তোমার চশমা দেখছে মা।
মতির বুকের ভিতর চিপটিপ করে। তাহাকে বসিতে দেওয়া হইয়াছে সম্মানের আসনেই সামনের দিকে, পিছনে আশ্রিত পরিজনদের মধ্যে নয়। শীতলবাবু নিজে মেয়েটিকে সঙ্গে করিয়া পৌঁছাইয়া দিয়া বলিয়াছেন, সামনে বসিয়ো। শশী ডাক্তারের বাড়ির মেয়ে।
কাল শশী ডাক্তারের বাড়ির মেয়েরা যত বিশ্রী করিয়াই হোক খুব সাজিয়া আসিয়াছিল, এর আজ এ কী বেশ। শীতলবাবু আর বিমলবাবুর বাড়ির মেয়েরা এই কথা ভাবিয়াছিল। তাহারা কাপড় চেনে, গয়না চেনে, নিজেদের ঘষে এবং মাজে। ও মেয়েটা, ধরতে গেলে, রীতিমতো নোংরাই।
শীতলবাবুর পুত্রবধূ গতবার ছেলে হওয়ার সময় বাজিতপুরের সিভিল সার্জন আসিয়া পড়ার আগে শশীর হাতেই জীবন সমর্পণ করিতে বাধ্য হইয়াছিল। বিছানায় শুইয়া শুইয়া লভেল পড়ার সে কী ভীষণ শাস্তি! যাই হোক ছেলেটি ঝির কাছে দোতলায় এখন চোখ বুঝিয়া ঘুমাইতেছে। সিভিল সার্জন করিয়াছিল কচু, ছেলেটা একরকম শশী ডাক্তারের দান বইকী শীতলবাবুর পুত্রবধূ তাই একসময় মতিকে কৌতুহলের সঙ্গ জিজ্ঞাসা করিল, শশী ডাক্তার তোমার কে হয় গো?
কেউ না।
ওমা! কেউ না? এই রাত্রে তুমি পরের সঙ্গে যাত্রা দেখতে এলে?
পর কেন? দাদার সঙ্গে এসেছি।
তোমার দাদা কে? কাদের বাড়ির মেয়ে তুমি?
আমি ঘোষবাড়ির মেয়ে,–আমার বাবা স্বর্গীয় হারানচন্দ্র ঘোষ।
কথাটা শীঘ্রই রটিয়া গেল। হারু ঘোষের মেয়েকে তাহাদের মধ্যে গুজিয়া দেওয়ার স্পর্ধায় শশীর উপর শীতলবাবু আর বিমলবাবুর পরিবারের মেয়েরা বিশেষ অসন্তুষ্ট হইলেন। মতির কাছে যাহারা ছিলেন, তাহারা বাড়ির মধ্যে যাওয়ার ছলে উঠিয়া গেলেন এবং ফিরিয়া আসিয়া অন্যত্র বসিলেন। হাত-পা ছড়াইয়া আরাম করিবার সুযোগ পাইয়াও মতির কিন্তু আরাম হইল না। অবহেলা অপমান বুঝিতে না-পারার মতো বোকা সে তো নয়।
এদিকে শশী মাঝে মাঝে সাজঘরে যায়। কুমুদকে প্রশংসা করিয়া বলে, বেশ হচ্ছে কুমুদ। তুই কলকাতার থিয়েটারে গেলি না কেন?
কুমুদ খুশি হইয়া বলে, ভালো হচ্ছে? চোদ্দো বছর উপোস করতে হয়েছে ভাই। তবু এখনো বউদিকে রাবণের হাত থেকে উদ্ধার করতে পারিনি। অযোধ্যায় ফিরিয়ে নিয়ে গিয়ে দাদাকে রাজা করতে পারলে বাঁচি।
কুমুদ হাসে। খানিক পরে অশোকবন থেকে বউদিকে আনতে যাব–রাবণবধ হতে বেশি দেরি নেই। সে সিনটা দেখিস। হ্যারে, তোদের গাঁয়ে গয়নার দোকান আছে?
শশী বলিল, গয়নার দোকান! গয়নার দোকান কোথায় পাব? দুটো স্যাকরার দোকার আছে, ফরমাশ দিয়ে গয়না তৈরি করে দেয়। ছোটো ছোটো দুটো একটা গয়না সময় সময় তৈরি করেও রাখে হয়তো, দোকান করার মতো কিছু নয়। গয়না কিনবি নাকি?
কিনব? আমি? কেন, গয়না কিনব কেন?
শশী একটু বিচলিত হয়। কুমুদ গয়নার দোকানের কথা জিজ্ঞাসা করিয়াছে কেন? তাও এক কথা বলিতে বলিতে হঠাৎ জিজ্ঞাসা করিয়াছে। কী ভাবিতেছে ও?
শশী ভাবে সৃষ্টিছাড়া গোয়ার ছেলে, জগতে এমন কাজ নাই যা করে না,–এইসব করিয়াই যেন সুখ পায়। কিন্তু গয়নার দোকানের খবর নেয় কেন? শশী আরও ভাবে যে খবর লইতে হইবে বিনোদিনী অপেরাপার্টি বাজিতপুরে অভিনয় করার সময় সেখানকার কোনো গয়নার দোকানে কিছু ঘটিয়াছে কি-না।
শশীর মনের মধ্যে সন্দেহটা খচখচ করিয়া বেঁধে বইকী। সে মনে করে বইকী যে আচ্ছা পাগল সে, এ কী কথা এও কী কখনও হয়? তবু সে ভাবিয়া রাখে, বাজিতপুরের গয়নার দোকানের গত দুমাসের কুশল কালই জানিবার চেষ্টা করিবে। এই অন্যান্য কাজটা করিবার আগাম প্রায়শ্চিত হিসাবে রাত বারোটার সময় বাড়ি ফেরার আগে কুমুদকে তাহার ওখানে আহারের নিমন্ত্ৰণ করিয়া যায়।
পরাণকে বলে, মতিকে এবার বাড়ি নিয়ে যাও না পরাণ? কত রাত জাগবে?
পরাণেরও ঘুম পাইয়াছে। সে বললে, যাবে কী!
কিন্তু মতি ডাকিবামাত্র চলিয়া আসে। আজ যাত্রা শুনিতে তাহার ভালো লাগিতেছিল না। সে কাঁচা মনে বিনা-কারণেই সর্বদা আনন্দ ভরিয়া থাকে, যেকোনো একট তুচ্ছ উপলক্ষে মনে যাহার উত্তেজিত সুখ হয়, শীতলবাবু আর বিমলবাবুর পরিবারের মেয়েরা যাত্রা শোনার উৎসাহ তাহার নষ্ট করিয়া দিয়াছে। মতি যেন চুরি করিয়া বাড়ি ফিরিল। তবু, কী সুন্দর ওই মেয়েমানুষগুলি একএকজন যেন এক-একটি ছবি।
হারু ঘোষ যেখানে বজ্রাঘাতে মরিয়াছিল, সেখানটা বিষাক্ত সাপের আস্তানা। হারু ঘোষের বাড়ির কাছে তালবনের সাপগুলির বিষ নাই। বিষ নাই? কুমুদকে যে সাপট কামড়াইয়াছিল সেটার বিষ ছিল না। সেটা জলের সাপ, টোঁড়া সাপ। কিন্তু তালবনের সাপ কি জলের সাপ, সব সাপ কি টোড়া সাপ? কে বলিবে! মতি তাহা জানে না। শেষপর্যন্ত তাহাকে স্বীকার করিতে হয় যে অন্য সাপে কামড়ালে হয়তো যেতেন মরে।
মতির দুকানে দুটি মাকড়ি দোলে। মাকড়িদুটির চাদদুটির কোলে একরতি তারাদুটিও দোলে। কুমুদ নিজের হাতে তাহাকে মাকড়ি পরাইয়া দিয়াছে। ওর মধ্যে একটা নূতন ঝকঝকে অন্যটা অনেক দিনের পুরোনো, মলিন। এ একটা সমস্যার কথা বইকী! মতি যত বোকাই হোক-আসলে সে আর এমন কী বেশি বোকা? এটুকু মতি খেয়াল করিয়াছিল। নূতন মাকড়ি দেখিলেই সকলে ধরিয়া ফেলিবে যে দে বলবে কী? কৈফিয়ত দিবে কী? রাজপুত্র প্রবীর, দুপুরবেলা তালপুকুরের ধারে মাকড়িটি নিজের হাতে তাহার কানে পরাইয়া দিয়েছে শুনিলে বাড়িতে তাহাকে আর আস্ত আস্ত রাখিবে না। কুমুদ এ সমস্যার মীমাংসা করিয়া দিয়াছে। বাড়ি যাওয়ার আগে (বাড়ি যেন মতির কত দূর!) কান হইতে দুটা মাকড়িই মতি খুলিয়া ফেলিবে। রাত্রে তেতুল মাখাইয়া রাখিয়া দিয়া সকালে সোডা দিয়া মাজিলে দুটি মাকড়িকেই মনে হইতে মাজিয়া ঘষিয়া পরিষ্কার করা পুরানো মাকড়ি। জিজ্ঞাসা করিলে মতি বলিবে, সাফ করেছি। তেতুল দিয়ে আর সোডা দিয়ে। মতি এই কথা বলিবে! এই সত্য কথাটা।