অন্য মাকড়িটি মতি আঁচলে বাঁধিয়া রাখিয়াছিল। খুলিয়া দেয়। খুবই সাদাসিধে মাকড়ি, একটুকরা চাঁদের কোলে একরত্তি একটা তারা। তারার তলে চাঁদটা দোলে।
মাকড়ি হারিয়েছে কাউকে বোলো না খুকী।
কেউ টের না পাইলে মতি আপনা হইতে অবশ্যই বলিবে না। কিন্তু কেন?
কাল তোমাকে একটা মাকড়ি এনে দেব।
মতি অবাক হইয়া যায়।
পাবেন কোথায়?
কেন, গায়ে তোমাদের গয়নার দোকান নেই?
কিনে আনবেন!–মতির মনে হয় মাকড়ি কেনার আগে প্রবীর তাকেই কিনিয়া ফেলিয়াছে।
তাহার মাকড়িটা পকেটে ভরিয়া কুমুদ চলিয়ে গেলে, পুকুরঘাটে বসিয়া বসিয়া সে এই কথাটাই ভাবে। তাহাকে একটা মাকড়ি দেওয়া প্রবীরের কাছে কিছুই নয়। আর কত মেয়েকে হয়তো সে অমল কত দিয়াছে। বেশি না থাক, যাত্রার দলে দুটো একটা মেয়েও কি নাই? তবু তাহাকেই মাকড়ি দিতে চাওয়ার জন্য প্রবীর কী ভয়ানক ভালো।
আজ তাহাদের যাত্রা শুনিতে যাওয়া বারণ। পরাণ নিষেধ করিয়া দিয়াছে। রোজ রোজ যাত্রা শোনা কী? একদিন শুনিয়া আসিয়াছে, আজ বাদ যাক, কাল আবার শুনিবে। পরাণ ওদের যাত্রা শুনিতে যাওয়া পছন্দ করে না। কেন করে না তার কোনো কারণ নাই। ওরা যাত্রা শুনিয়া বেলা দশটা পর্যন্ত পড়িয়া পড়িয়া ঘুমাক আর না ঘুমক, পরাণের কিছুই আসিয়া যায় না। প্রতিদিন প্রদোষের আধো-অন্ধকারে সে যখন বাহির হইয়া যায়, এ বাড়িতে কারো ঘুম ভাঙে না। তাহার সুখ-সুবিধার দিকে তাকানোর অভ্যাস এ বাড়িতে কাহারো নাই। এক বেলা ভাতের বদলে মুড়ি খাইয়া থাকিতে হইলে নালিশ করা পরাণকে দিয়া হইয়া উঠে না। তবু সে চায় না বাড়ির মেয়েরা যাত্রা শুনিতে যায়। পর পর দুদিন যাত্রা শুনিতে যায়।
তুমি যাবে না? না, নিজের বেলা ভিন্ন নিয়ম? কুসুম বলিল। সে রাগিয়াছে।
আমার সঙ্গে তোমার কথা কী? ব্যাটাছেলে নাকি?
তুমি গেলে আমিও যাব।
আমি যাব না তবে পরাণও মাঝে মাঝে গোঁ ধরতে জানে।
কুসুম বলে, তুমি যাও না যাও আমি কিন্তু যাব।
চুলোয় যাও।
মুখে যাই বলুক, কুসুম যাত্রা শুনিতে যাওয়ার কোনো আয়োজনই করিল না। পাড়ার অনেক বাড়ির মেয়েরা যাইবে। কুসুমও তাদের সঙ্গে যাইতে পারে। কিন্তু যাওয়ার চেয়ে না-যাওয়ার মধ্যেই এখন রাগ ও অভিমান বেশি প্রকাশ পায়, জিদও তাহাতেই বজায় থাকে বেশি। কুসুম তাই সারাটা দুপুর ঘুমাইয়া কাটাইয়া দিল।
সন্ধ্যার সময় বাজনার শব্দ শুনিয়া অস্থির হইয়া উঠিল মতি। প্রবীর আজ লক্ষ্মণ সাজিবে। কীরকম না জানি আজ দেখাইবে তাহাকো পারিলে মতি একাই চলিয়া যাইত। দু বছর আগেও এমন সে গিয়াছে। এখন আর সেটা সম্ভব নয়। দুবছরের মধ্যে সে যে কী ভয়ানক বড় হইয়া গিয়াছে ভাবিলেও মতির চমক লাগে। কিন্তু কী করা যায়। অমন করিয়া বাজনা বাজিতে থাকিলে ঘরেও টেকা অসম্ভব।
একসময় কুসুমকে সে বলিল, যাত্রা নাই শুনি, ঠাকুর দেখে আসি চল না বউ?
পরাণ দাওয়ায় বসিয়া অর্থসমস্যার কথা ভাবিতেছিল। সে ডাকিয়া বলিল, এদিকে শোন মতি, শুনে যা।
মতি কাছে আসিল কী বলছিলি?
ঠাকুর দেখতে যাব।
ঠাকুর দেখতে যাবি? আচ্ছা, চল। একটু যাত্ৰাও শুনে আসবি অমনি। ।
পরাণ অমনিভাবে একরকম স্পষ্টই হার স্বীকার করিল। কিন্তু কুসুম আর যাইতে রাজি নয়। এখন খাওয়াদাওয়া সারিয়া পান সাজিয়া যাইতে যাইতে পালা শেষ হইয়া যাইবে না।
ঠাকুরপূজার বাদ্য বাজছে। পালা শুরু হতে ঢের দেরি।–পরাণ উদাসভাবে বলিল।
মতি বলিল, চল না বউ? অমন করিস কেন?
কুসুম বলিল, গিয়ে বসবি কোথায়? তোর জন্যে জায়গা ঘুমোচ্ছে সৰ্ব্বাইয়ের পেছনে বসে যাত্রা শোনার চেয়ে ঘরে শুয়ে ঘুমানো ঢের ভালো।
পরাণ বলিল, ছোটোবাবুকে বললে—
ছোটোবাবুর নামোল্লেখে কুসুম আরও রাগিয়া কহিল, ছোটোবাবু কী করবে? জায়গা গড়িয়ে দেবে?
পরাণ বলিল, ছোটোবাবুর বাড়ির সবাই বাবুদের বাড়ির মেয়েদের জায়গায় বসে। নেটের পর্দা টাঙানো, দেখিসনি মতি? বাবুদের বাড়ি ছোটোবাবুর খাতির কত। ছোটোবাবুকে বললে তোদের ওইখানে বসিয়ে দেবে।
কুসুম হঠাৎ শান্ত হইয়া বলে, আমি যাব না।
তাহাকে আর কোনোমতেই টলানো যায় না। বাবুরা জমিদার, শশীরা বড়লোক। ওদের বাড়ির মেয়েদের কত ভালো-ভালো কাপড়, কত দামি দামি গয়না। একটা জবরজঙ্গ লেস-লাগানো জ্যাকেট গায়ে দিয়া তাতিবাড়ির কোরা কাপড় পরিয়া ওদের মাঝখানে (মাঝখানে তাহাকে বসিতে দিবে না ছাই, এককোণে ঝির মতো বসিতে হইবে) গিয়া বসিলে দম আটকাইয়া যাইবে কুসুমের।
শেষপর্যন্ত পরাণের সঙ্গে মতি একাই গেল। শশীকে খুঁজিতে হইল না। সে বাড়িতেই ছিল। সে বলিল, তোর তো কম শখ নয় মতি! কিন্তু সঙ্গে গিয়া মতির বসিবার একটা ভালো ব্যবস্থা করিয়া দিতে সে আপত্তি করিল না। বরং নেটের পর্দার আড়ালে, যেখানে বাবুদের বাড়ির মেয়েরা বসে, মতিকে সেখানে বসাইতে পারিয়া সে বিশেষ গর্বই বোধ করিতে লাগিল।
শীতলবাবুদের বাড়ির মেয়েরা গায়ে সিল্কের ব্লাউজ দেয়, বোম্বাই শাড়ি পরে। শীতলবাবুর ভাই কলিকাতা-প্রবাসী বিমলবাবুর স্ত্রী-কন্যারা পায়ে জুতাও দিয়া থাকে। দু’ভায়ের পরিবারের নারীর সংখ্যাও কি কম! সংসারে যেখানে যত টাকা সেখানে তত নারী, সেখানে তত পাপ। মতি সংসারের এ নিয়ম জানিত না সংসারে কোন নিয়মটাই বা সে জানে? কাঁচা মেয়ে সে, বোকা মেয়ে। প্রায় কুড়ি বগফিট পরিমাণ পরিষ্কার চাদরের উপর গাদা করা ঘষামাজা সাজানো গোছানো স্বজাতির মধ্যে আসিয়া পড়িয়া সে যেন দিশেহারা হইয়া গিয়াছিল।