তোর মাথা। চুপ কর, শুনতে দে।
প্রবীরের প্রবেশ দ্বিতীয় দৃশ্যে। গঙ্গাদেবীর পুত্ৰঘাতী অৰ্জুনকে যথাবিধি শাস্তি দিবার প্রতিজ্ঞামূলক একপৃষ্ঠাব্যাপী স্বগত উক্তির পরেই। প্রবীরকে দেখিয়াই আসর মুগ্ধ হইয়া যায়। স্মার্ট সাজপোশাক, কী লালিত্যময় যৌবনমূর্তি, তলোয়ারটা কী চকচকে। কথা যখন সে বলে, আসরে একটা শিহরন বহিয়া গিয়া শ্রোতারা যেন পরম আরামবোধ করে। জমিবে, প্রবীরের পার্ট জমিবে। খাসা জমিবে। যেমন রাজপুত্রের মতো চেহারা, তেমনি চমৎকার গলা। প্রবীরের প্রিয়া মদনমঙ্গরীও আসরে আছেন। এত লোকের মাঝে এ যেন একান্ত নির্জন রাজোদ্যান, এমনি নিঃসঙ্কোচ নির্ভুল আবেগমথিত স্বরে প্রবীর তাহাকে ভালোবাসিতে থাকে। যাত্রার আসরে হাত ধরার অতিরিক্ত প্রেমস্পর্শ নিষিদ্ধ। সেজন্য প্রবীরের কোনো অসুবিধা আছে মনে হয় না। শুধু কথায়, শুধু অভিনয়ে এতগুলি লোকের মনে সে বিশ্বাস জন্মাইয়া দেয় যে তাহারা দুজন একদেহ একপ্রাণ!
অবাক হয় কুসুম, আর মতি।
কুসুম বলে, ওলো, এ যে সেই লোকটা!
মতি বলে, কী সুন্দর করছে বউ, মনে হচ্ছে যেন সত্যি!
কুসুম একটু হাসে, যেন তোর সঙ্গেই করছে, না?
মতি জবাব দেয় না। শোনে।
প্রবীর বলে :
রাগ করিয়াছ?
কেন রাগ করিয়াছ অবোধ বালিকা?
কেন এত অভিমান? দুটি চোখে
কেন এত ভর্ৎসনা? মুখে মেঘ
উঠিতেছে বুক দেখে মনে হয়
মন্দ বলিয়াছি।
এ গাম্ভীর্য, হাসিহীন এত কঠোরতা
ফুলে কি মানায়, সখি,
মানায় কুসুমে? আমি তোরে ভালোবাসি,
সত্য কহিয়াছি, প্রাণদিয়ে ভালোবাসি তোরে।
সাক্ষী নারায়ণ। সাক্ষী মোর হৃদয়ের
মতির বুকের ভিতর শিরশির করে। কুসুম মনে-মনে অধীর হইয়া ভাবে বল না লক্ষ্মীছড়ি, রাগ করিনি; মুখ ফুটে ও-কথাটা তুই আর বলতে পারিস না? ধন্য প্রাণ তোর।
রাত তিনটা অবধি যাত্রা শুনিয়া আসিয়া ঘুম ভাঙিতে পরদিন সকলেরই বেলা হয়। হয় না শুধু শশী আর পরাণের। যামিনী করিবাজের বউ রোগের বিপজ্জনক অবস্থায় উপনীত হইয়াছে। সকাল সকাল উঠিয়া স্নান করিয়া শশী তাহার কাছে যায়। পরাণের ক-বিঘা জমির ফসল অবিলম্বে ঘরে না-তুলিলেই নয়। নিজে উপস্থিত না-থাকিলে সাতাশটা খেজুরগাছের রসই তাহার অর্ধেক চুরি হইয়া যাইবে।
তালগাছ ছাড়া আর কোনো গাছ পরাণ এবার জমা দেয় নাই। এবার সে নিজেই খেজুররম জ্বল দিয়া গুড় করবে। ডাঙা জমিতে এবার সে কিছু মূলারও চাষ করিবে স্থির করিয়াছে। শশী বলিয়াছে, জমিতে হাড়ের সার দিলে মূলা ভালো হয়। দশ সের গুড়া হাড় পরাণ পরীক্ষার জন্য আনাইয়া লইয়াছে। এখনো জমিতে দেওয়া হয় নাই। পরাণের অনেক কাজ।
দুপুরে কুমুদ শশীর বাড়িতে আসিল। শশী বাড়ি ছিল না। গোপাল জানিয়াছে কুমুদ যাত্রা করে। কুমুদকে সে বাড়ির বেড়া পার হইতে দিল না। বাহিরের ঘরে বসাইয়া রাখিল।
দাবা খেলতে পারো হে?
আজ্ঞে না।
গোপাল তখন বাড়ির মধ্যে গেল ঘুমাইতে। কুমুদ, গত রাত্রের হাজার নরনারীর হৃদয়জয়ী কুমুদ, নিজেকে পরিত্যক্ত বন্ধুহীন মনে করিয়া গেল তালপুকুরের ধারে। সেখানে তাহার বন্ধু জুটিল মতি।
মতি কি মাঝে মাঝে তালপুকুরে কবিত্ব করিতে আসে? নিঝুম দুপুরের অলস প্রহরগুলি ঘরে কি তাহার কাটে না? কে বলিবে! আজ কিন্তু সে বিশেষ দরকারেই তালপুকুরে আসিয়াছিল। পুকুরপাড়ে কাল সে কানের একটা মাকড়ি হারাইয়াছে। যাত্রা দেখার উৎসাহে কাল খেয়াল থাকে নাই। আজ স্নানের সময় কানে হাত পড়িতে,-ওমা, মাকড়ি কোথায়? ভয়ে কথাটা সে কাহাকেও বলে নাই। দুপুরে সকলে ঘুমাইলে চুপিচুপি খুঁজিতে আসিয়াছে।
রুপা নয়, তামা নয়, সোনার মাকড়ি। কী হইবে?
মাকড়ি মতি পাইল না। পাইল কুমুদকে। উভয় পক্ষই কৃতাৰ্থ হইয়া গেল! কুমুদ এ জগতের রক্তমাংসের মানুষ নয়, রূপকথার রাজপুত্র, মহাতেজা, মহাবীর্যবান, মহামহা প্রেমিক। হা, কুমুদ মাটির পৃথিবীর কেহ নয়। পৃথিবীর সেরা লোক শশী, কুমুদ শশীর মতোও নয়। ছোটোবাবুর কথা মতি কী না জানে? ছোটোবাবু কী খাইতে ভালোবাসে তা পর্যন্ত। কুমুদ কী খায় কে তার খবর রাখে? শার্ট-পরা কুমুদ হইল রাজপুত্র প্রবীর। শশী কে?
কী খুঁজছ খুকী?
মতি বলে। বলিতে মতির ভালো লাগে। সোনার মাকড়ি হারানো যেন বাহাদুরির কাজ। বলে, বাড়িতে জানালে মেরে ফেলবে।
মেরে ফেলবে? বাড়িতে তোমাকে খুব মারে নাকি?
এমনি মারে না। দামি জিনিস হারালে মারে। আজ আপনি কী সাজবেন?
রাবণ। কুমুদ হাসে।
হ্যাঁ, রাবণ বইকী রাবণ তো দেখতে বিশ্ৰী?
কুমুদ খুশি হইয়া বলে, লক্ষ্মণ সাজব।
মতি উৎসুক হইয়া জিজ্ঞাস করে, উৰ্মিলা কে সাজবে? কাল যে আপনার বউ সেজেছিল সে? আচ্ছা, ও তো ব্যাটাছেলে, অ্যাঁ?
কুমুম বলে, ব্যাটাছেলে বইকী।
মতির সঙ্গে কুমুদও মাকড়ি খোঁজে। তালপুকুরের ভাঙাচের ঘাট হইতে তালবনের মাঝামাঝি পর্যন্ত পায়ে-চলা পথের দুধারে।
বাড়ির কাছে পৌঁছিয়া যাওয়ার ভয়ে মতি বলে, ওদিকে নেই, আমি ভালো করে খুঁজেছি। ভাবে, প্রবীর চলিয়া গেলে এখান হইতে বাড়ি পর্যন্ত সে নিজেই খুঁজিয়া দেখিবে। খুঁজিতে খুঁজিতে দুজনে আবার ঘাটে ফিরিয়া যায়।
মতি বলে, কোথায় পড়ে গেছে কে জানে ও আর পাওয়া যাবে না।
না পেলে তোমায় মারবে, না? কে মারবে?
কে মারিবে মতি তাহার কী জানে? একজন কেউ নিশ্চয়।
তবে তো মুশকিল। কুমুদ চিন্তিত হইয়া বলে।
বলে, তোমার আর একটা মাকড়ি কই? দেখি, কী রকম?