মোক্ষদাকে একখানা ফরসা কাপড় পরিতে দেখিয়া পরাণ জিজ্ঞাসা করে, তুমিও যাবে নাকি মা, যাত্রা শুনতে?
না, আমার আবার যাত্রা কী?
জোর করিয়া ধরিলে মোক্ষদা যাইতে রাজি আছে। কিন্তু এরা কেউ যাইতে বলিবেও না। আগে হইতেই মোক্ষদা তাহা জানে। তাই সাতরাদের বুড়ি পিসির সঙ্গে সে আগেই ঠিক করিয়া রাখিয়াছে। তারা দুজনে যাত্রা শুনিতে যাইবে। বাড়ি আসিয়া মেক্ষদা তাহা হইলে বলিতে পারবে, যাত্রা শুনিবার শখ তাহার একটুও ছিল না। কী করিবে, আর একজন টানিয়া লইয়া গেল। জোর করিয়া টানিয়া লইয়া গেল।
পরাণ বলে, ফরসা কাপড় পরে তুমি তবে যাচ্ছ কোথা?
সাতরাদের বাড়ি যাবি বাবা। যদুর পিসি একবার ডেকেছে।
কুসুম ঝা করিয়া সামনে আসিয়া পড়ে।
কাল যেও মা, কাল যেও। আমরা এখন বেরোব, তুমি চললে সাতরাদের বাড়ি। বাড়িতে তা হলে থাকবে কে?
মোক্ষদা তার কী জানে। যার খুশি থাক।
তোমরা যাবে যাত্রা শুনতে, বাড়ির ব্যবস্থা তোমরাই করো বাছা। আমি তার কী জানি? আমি বুড়োমানুষ, সব ব্যাপারে আমাকে টানো কেন? আমি আছি নিজের শতেক জ্বালায়।
কুসুম রাগিয়া বলে, জ্বালা বাপু সংসারে সবারই আছে। ঘরে বসে জ্বললেই হয়। এমন শয়তা করা কেন? আগেই জানি শেষকালেতে ফ্যাকড়া বাধবে।
মোক্ষদা বোধহয় একটু লজ্জাবোধ করে। হয়তো তাহার মনে হয় বুড়োমানুষের যাত্রা শুনিতে যাওয়ার জন্য এত কাণ্ড করা উচিত নয়। বাড়িতে থাকিতে রাজি হইয়া সে গুম হইয়া বসিয়া থাকে।
রান্না শেষ করিয়া কুসুম স্বামীকে খাওয়ায়, তারপর ননদের সঙ্গে এক থালায় নিজে খাইতে বসে। পরাণ পেট ভরিয়া খায়, কুসুম আর মতির গলা দিয়া আজ ভাত নামিতে চায় না। ফেলা-ছড়া করিয়া কোনোরকমে তাহারা খাওয়া শেষ করে। দিনের আলো যত স্নান হইয়া আসে মনের মধ্যে তাহাদের এই আশঙ্কা ততই প্রবল হইয়া উঠে যে, ওদিকে বুঝি যাত্রা শুরু হইয়া গেল। মতিকে কাপড় পরিতে হুকুম দিয়া কুসুম হেশেল তুলিয়া । ফেলে। পুকুর যাওয়ার সময় এখন নাই। উঠোনের এককোণে ছাইফেলা আমগাছটির তলে বসিয়া বাসন ক’খানা কুসুম তাড়াতাড়ি মজিয়া নেয়। এই সুবিধাটুকুর ব্যবস্থা সে সেই বিকালেই করিয়া রাখিয়াছে। দু কাখে দুটি কলসি বহিয়া কত জল তুলিয়া কুসুম যে আজ হাড়িগামলা ভর্তি করিয়াছে।
মতি বলে, আমিও হাত লাগাই বউ, শিগগির হয়ে যাবে, অ্যাঁ।
না। মতি তাড়াতাড়ি কাজ করিতে পারে এ-বিশ্বাস কুসুমের নাই। এক মিনিটের কাজে মতি দশ মিনিট লাগাইয়া দেবে।
যা বললাম তাই কর তো তুই। কাপড় পরতেই তো তোমার দশ ঘণ্টা।
একসময় গোধূলি শেষ হওয়ার আগেই, কী করিয়া কাজ শেষ হয়। বাকি থাকে শুধু এটা আর ওটা, যা করিলেও চলে, না করিলেও চলে। কুসুমের তাড়ায় পরাণ ও মতি দুজনেই কাজ সমাপ্ত করিয়াছে। নিজে সাজিতে গিয়া ওদের দুজনকে দেখিয়া কুসুম এতক্ষণে একটু হাসিল। শার্টের উপর উড়ানি চাপানোয় পরাণকে একেবারে বাবু-বাবু দেখাইতেছে। আর ডুরে শাড়ি পরিয়া মতি হইয়াছে সুন্দরী। মতির হালকা অপরিণত দেহটাকে কুসুম হিংসা করে। মনে হয় তাহার নিজের স্বাস্থ্য এতখানি ভালো না হইলেই যেন সে খুশি হইত। ডুরে শাড়ি তারও আছে বইকী। তবে আজকাল রঙিন লাইন দিয়া শশীর ঢাকিতে কুসুমের লজ্জা
করে।
আসরে যখন তাহারা পৌঁছিল, যাত্রা আরম্ভ হইতে বিলম্ব আছে। চিকের আড়ালে জায়গার জন্য কলহ শুরু হইয়া গিয়াছে ইতিমধ্যেই। সকলেই চিক ঘেষিয়া বসিতে চায়, এগারো বছরের সদ্য-পদা-পাওয়া মেয়ে হইতে তাহার পঞ্চাশ বছরের দিদিরা পর্যন্ত।। এসব বিষয়ে কুসুম ভারি ওস্তাদ। সকলকে ঠেলিয়া-ধুলিয়া সেই-যে সে চিকের কাছে প্রথম সারিতে একটা দশ ইঞ্চি ফাঁকের মধ্যে নিজেকে গুজিয়া দিল, কেহ আর তাহাকে সেখান হইতে নড়াইতে পারিল না। মতি তাহার পিঠের সঙ্গে মিশিয়া সংস্কৃত সাহিত্যের ছুচের পিছনে সূতা চলার উপমার মতো আগাইয়া আসিয়াছিল। কুসুমের পিঠ ঘেষিয়া সে একরকম চরণ দত্তের গৃহিণীর কোলের উপরেই বসিয়া পড়িল। চরণ দত্তের গৃহিণী । তাহাকে ঠেলিতে আরম্ভ করায় কুসুমের কোমর সে জড়াইয়া ধরিল প্রাণপথে।
কুসুম মুখ ফিরাইয়া চোখ রাঙাইয়া চরণ দত্তের গৃহিণীকে বলিল, মেয়েটাকে ঠেলছ কেন গা? কেন ঠেলছ? গাল দিলে ভালো হবে। সরে বোসো, জায়গা দাও। সবাই বসবে, সবই দেখবে-তোমার একার জন্য তো যাত্রা নয়?
কুসুমকে মতির এত ভালো লাগিল! কুসুমের কাছে মতি এত কৃতজ্ঞতা বোধ করিল!
যাত্রা শুরু হওয়ার একটু আগে কুসুম বলিল, ওই দ্যাথ মতি, ছোটোবাবু।
দেখেছি।
এত লোক, এত আলো, এত শব্দ-মতির নেশা লাগিয়া গিয়াছিল। পাটকরা মুগার চাদরটি কাধে দেওয়ায় শশীকে ভারি বাবু দেখাইতেছে। সে আসরে আসিয়া দাঁড়ানো মাত্র মতি তাহাকে দেখিতে পাইয়াছিল। স্বয়ং শীতলবাবু তাহাকে ডাকিয়া কাছে বসাইলেন দেখিয়া শশীর সম্মানে মতিরও সম্মানের সীমা নাই।
শামিয়ানার তলা ভরিয়া গিয়া খোলা আকাশের নীচে পর্যন্ত লোক জমিয়াছে। দুজন স্থূলকায়া গৃহিণীর মাঝে পড়িয়া মতির গরম বোধ হইতেছিল। এদিকে একসময় বাজনা বাজিয়া ওঠে। কনসার্ট-ঐকতান। শুনিলে এমন উত্তেজনা বোধ হয়! কিছু একটা উপভোগ্য ঘটিবার প্রত্যাশা, তারপর বাজনা থামিয়া যাত্রা শুরু হয়। ষোলোজন সখী আসিয়া নৃত্য আরম্ভ করে। তাদের পরনে পশ্চিমা ঘাগরা।
মতি ফিসফিস করিয়া বলে, ব্যাটাছেলে সখি সেজেছে, না বউ?
সখীরা লাচিয়া গেলে প্রবেশ করেন জনা ও অগ্নিদেব। জনাকে দেখিয়া মতির সন্দেহ হয়। ও নিশ্চয়ই মেয়েমানুষ, বউ! না?