শশীকে যামিনী কবিরাজের বউ-এর কাছে যাইতে হইবে। এ কর্তব্য অবহেলা করিবার উপায় ছিল না। বন্ধুকে খই-এর মোয়া আর চন্দ্রপুলি খাওয়াইয়া শশী বিদায় লইল।
গ্রামে পর্দপ্রথা শিথিল কিন্তু সে গ্রামেরই চেনা মানুষের জন্য। শশীর বাড়ির মেয়েরা সকালবেলা অন্তঃপুরে পাক খায়। কুমুদ উৎসুকদৃষ্টিতে খোলা দরজা দিয়া প্রকান্ড সংসারটির গতিবিধি যতটা পারে দেখিতেছিল। খানিক পরে ছোট একটি ছেলে আসিয়া দরজাটা ভেজাইয়া দিয়া গেল। কুমুদ আহত হইয়া ভাবিল, আমি তো ওদের দেখিনি! ওদের কাজ দেখছিলাম যে আমি। সকলে মিলে কী রচনা করছে তাই দেখছিলাম।
জামাটি গায়ে দিয়া কুমুদ বেড়াইতে বাহির হইয়া গেল। একটা পরিবারের গোপন মর্মস্পন্দন দেখিয়া ফেলার অপরাধ একা-একা অন্তঃপুরের একটা ঘরে বসিয়া সহ্য করা কঠিন।
বাড়ির পিছনে তালবনের ওপাশে উঁচু মাটির টিলাটির দিকে। সে সেইদিকে চলিতে আরম্ভ করিল। জীবনে সে যত পুণ্য অর্জন করিয়াছে, তার পাপের হিসাবটা আজ এখানকার মতো ধরিয়া তালবনের গভীর নির্জনতায় হঠাৎ তাহার পুরস্কার কে দিল, মানুষের বুদ্ধিতে তাহার বিশ্লেষণ নাই। হয়তো শশীর বাড়ির মেয়েরা অকারণে তাহাকে যে লাঞ্ছনা দিয়াছিল, জীবনের নিরপেক্ষ দেবতা ভোরের বাতাস পাখির কলরব আর ঋজু তালগাছগুলির প্রহরায় রক্ষিত যুগান্তের পুরাতন নিভৃত শাস্তির উপলক্ষে ক্ষতিপূরণ করিলেন। এত সহজে সেন্টিমেন্টাল করিয়া দিতে পারে, একটি সুখী পরিবারের অন্তঃপুর ছাড়া পৃথিবীতে এমন স্থান যে আছে কুমুদ তাহা জানিত না। এত কি কুমুদ জানিত যে এই অহেতুকি আনন্দ তাহার মৃত্যুরই শেষ ভূমিকা?
তালপুকুরের ধারে পৌঁছিয়া হঠাৎ তাহার মনে হইল, কী একটা রবারের মতো নরম জিনিসে পা পড়িয়াছে। চোখের পলকে হলুদ রঙের নরম জিনিসটার মুখ মাটি হইতে উঠিয়ে আসিয়া তাহার হাঁটুর কাছে কামড়াইয়া ধরিল। লেজের দিকটা জড়াইয়া গেল তাহার পায়ে।
কুমুদ জীবনে কত পাপ করিয়াছে, পরিমাণ তার কম নয়, অল্প একটু পুণ্যের কয়েক মিনিটব্যাপী অসাধারণ পুরস্কারের পর, এই তাহার শাস্তি। ঘাড় ধরিয়া সাপের মাথাটা কুমুদ হাঁটু হইতে ছিনাইয়া লইল।
সাপ। সাপ।
শুনিয়া আগে আসিল মতি, ভিজা শরীরে শুকনো কাপড়টা কোনোমতে জড়াইয়া।
কুসুম ওভাবে ছুটিতে পারে না। তাহার আসিতে দেরি হইল।
সাপ দেখিয়া মতি বলিল, ও তো ঢোঁড়া সাপ। জলে থাকে। ওর বিষ নেই।
কুমুদের মৃত্যুভয় প্রবল। কুসুম আসিয়া সায় না দেওয়া পর্যন্ত মতির কথা সে বিশ্বাস করিল না। বিশ্বাস করিয়াও হাঁটুর উপরে রুমাল দিয়া সজোরে বাঁধিয়া সন্দিগ্ধভাবে বলিল, শশীকে একবার ডেকে আনো খুকী, দেখুক। যদি বিষ থাকে? চেনো তো শশীকে? তোমাদের পাড়াতেই থাকে,- ডাক্তার।
কুসুম মুচকিয়া হাসিয়া বলিল, যা লো খুকী, ছোটোবাবুকে ডেকে আল। তাহার হাসিটা কুমুদের ভালো লাগিল না।
ছোটোবাবুর কে হন? খানিক পরে কুসুমের একথার জবাবে সে তাই সংক্ষেপে শুধু বলিল, কেউ না। বন্ধু।
ছোটোবাবু আমাদের বলতে গেলে একরকম আপনার লোক। দুবেলা আসেন।
একথা শুনিয়াও কুসুমকে হঠাৎ আত্মীয়া-জ্ঞান করিয়া বসিবার মতো মনের অবস্থা কুমুদের ছিল না। সে বলিল, ঢোড়া সাপের বিষ থাকে না কেন?
সব সাপের কি বিষ থাকে? টোড়া হল জলের সাপ। আমায় একবার কামড়েছিল। হয়তো ওই সাপটাই হবে। একদিন খুব ভোরে এই পুকুরে নাইছি, বেড়াতে বেড়াতে ছোটোবাবু এসে পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে গল্প করতে লাগলে। এমনি সময়ে সাপটা এইখানে কামড়ে দিল,-কুসুম তাহার লিভারটা দেখাইয়া দিল। তাহার বোধ হয় ধারণা ছিল মানুষের হৃদয়ের অবস্থানটা ওইখানে-ছোটোবাবুকে বললাম,সাপে কামড়েছে ছোটোবাবু। শুনে ছোটোবাবুর মুখ যা হয়ে গেল!
কী হয়ে গেল?–কুমুদ কৌতুহল বোধ করিতেছিল।
শুকিয়ে গেল। ছাইবৰ্ণ হয়ে গেল।
সাপের কামড়ে তোমার কিছু হল না?
কুমুদ তুমি বলায় কুসুম রাগ করিয়া বলিল, কথা বলতে শেখোনি দেখছি তুমি। ভদ্দরলোক তো?
তারপর দুজনেই দমিয়া যাওয়ায় আর কথা হইল না। তালগাছগুলি নিঃশব্দে দাঁড়াইয়া রহিল। একটা মাছরাঙা ঝুপ করিয়া তালপুকুরে আছড়াইয়া পড়িল।
দুপুরবেলাটা বন্ধুর সঙ্গে গল্প করিয়া কাটাইয়া বেলা পড়িয়া আসিলে কুমুদ বিদায় গ্রহণ করিল।
সকাল সকাল পালা শুরু হবে। যাবি তো শশী?
যাব বইকী! নিশ্চয় যাব।
হারুর বাড়ির পিছনে সাতগাঁ পর্যন্ত বিস্তারিত ধানের খেত। তালপুকুরের ধার হইয়া ক্ষেতের আল দিয়া কুমুদ সাতগাঁর কাছারিবাড়ি পৌঁছিল। তালপুকুরে সে মতিকে দেখিবার আশা করিতেছিল। কিন্তু যাত্রা শুনিতে যাওয়ার আয়োজনে ব্যস্ত মতির পুকুরে আসিবার সময় ছিল না। কুসুম রাধিতেছিল। সন্ধ্যার আগেই খাওয়ার পাট চুকিয়া যাওয়া চাই মতি বিনা-বাক্যব্যয়ে তাহার সমস্ত হুকুম পালন করিয়া যাইতেছিল।
পরাণ সব বিষয়ে উদাসীন। সন্ধ্যার আবির্ভাবে তাহার বোন আর বউ যত ব্যস্ত হইয়া ওঠে, সে যেন ততই ঝিমাইয়া যায়। রান্নাঘরে বসিয়া কুসুমের সঙ্গে সে প্রথম একটু গল্প জমাইবার চেষ্টা করিয়াছিল। গল্প করিবার সময় না-থাকায় কুসুম তাহাতে আমল দেয় নাই; দাওয়ায় বসে ইকা টান গে না বাপু মেয়েমানুষের আচল-ধরা পুরবষকে আমি দু চোখে দেখতে পারি না।–কুসুমের ভর্ৎসনায় চিরকাল পরাণের খারাপ লাগে। তবে স্পষ্ট খারাপ লাগার ভাবটা এত অল্প সময়ের মধ্যে মনের একটা উদাস বৈরাগ্য ও দেহের এতটা ঝিমানো আলস্যে পরিণত হইয়া যায় যে, রাগিবার অবসর প্রায়ই সে পায় না। মাঝে মাঝে কুসুমকে তাহার ভারি ছেলেমানুষ মনে হয়। চোদ্দ বছর বয়সে তার বউ হইয়া এতকাল কুসুমের শরীরটাই যেন বড়ো হইয়াছে, মনের বয়স বাড়ে নাই।