মতি কিছু দেখে না, কিছু শোনে না, কিছু শোকে না। তালপুকুরের নির্জনতাকে সে শুধু ভোগ করে গায়ে জড়ানো আচলটি কোমরে বধিয়া। গা উদলা করিয়া দেওয়াতেও কেহ যে তাহাকে দেখিতে পাইতেছে না ইহাতে মতির ভারি মজা লাগে।
সংসারের কাজ না করিলে কুসুম তাহাকে বকে। তালপুকুরের ধারে কাজ-ফাকি দেওয়া আলসাটুকু মতি ভোগ করে ভবিষ্যতের চিন্তা করিতে করিতে। সুদেবকে মনে । মনে মরিবার আশীৰ্বাদ করিয়া আরম্ভ না করিলে ভবিষ্যতের ভাবনাটা তাহার যেন ভালো খোলে না।
মতির ভারী ইচ্ছা, বড়োলোকের বাড়িতে শশীর মতো বরের সঙ্গে তার বিবাহ হয়। কাজ নাই, বকুনি নাই, কলহ নাই, নোংরামি নাই, বাড়ির সকলে সর্বদা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকে, মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে, হাসে, তাস-পাশা খেলে, কলের গান বাজায়, আর,—আর বাড়ির বউকে খালি আদর করে। চিবুক ধরিয়া তাহার লজ্জিত মুখখানি তুলিয়া বলে, লক্ষ্মী বউ, সোনা বউ, এমন না হলে বউ?
বলে, বাড়ি আলো হল!
স্বপ্ন মতির অফুরন্ত। মস্ত একটি ঘরের এককোণে সে বসিয়া আছে। সর্বাঙ্গে তাহার ঝলমলে গহনা, পরনে ঝকঝকে শাড়ি। ঘোমটার মধ্যে চন্দনচর্চিত মতির মুখখানি কী রাঙা লজ্জায় আনন্দে সে ছোট ছোট নি:শ্বাস ফেলিতেছে আর শুনিতেছে ঘরের বাহিরে । বড়লোকের বাড়ির প্রকান্ড সংসারের কলরব। শশীর বোনের মতো পাড়ার কে যেন একটি মেয়ে মতির সঙ্গে ভাব করিয়া গেল। যামিনী কবিরাজের বউ-এর মতো সুন্দরী একটি মহিলা, মতির বোধ হয় সে ননদই হইবে, পানের বাটা সামনে দিয়া বলিল, পান সাজো, বউ। ও সোনা-বউ, পান সাজো।
তারপর কে বলিল, বউমাকে খেতে দে তোরা কেউ একজন।
যেই বলুক, তালপুকুরের ধারে প্রকৃতির মহোৎসব হইতে বাড়ি ফেরার সময় মতি আবার তীব্রভাবে ইচ্ছা করে সুদেব ব্যাটা মরিয়া যাক।
কুসুমের সঙ্গে আজকাল প্রায়ই ঝগড়া বাধে মতির। সকলের অগোচরে মতিকে কুসুম শশীর কথা তুলিয়া অন্যায় পরিহাস করিতে আরম্ভ করিয়াছে।
বলে, শশীর খারাপ লাগছে মতি? তাই চুপ করে বসে রয়েছিল? আহা ঘাট। ছোটোবাবুকে ডাকব পরক্ষে করে ওষুধ দেবে?
মতি বলে, কেন লাগতে এলি বউ? তোর আমি কী করেছি।
কুসুম বলে, চোখ ছলছল করছে। দেখলে ছোটোবাবুর বুক ফেটে যাবে।
মতি বলে, যমের অরুচি। মর্ তুই, মর্।
কুসুম তবু বলে, জানিস লো মতি,–রাতে তোর কথা ভেবে ছোটোবাবুর ঘুম হয় না। বসে বসে মালা জপ করে, মতি, মতি, মতি। সুদেবের সঙ্গে তোর নিকে হয়ে গেলে ছোটোবাবু তালপুকুরে ডুবে আত্মহত্যা করবে।
তুই তালপুকুরে ডুবে মর। মরে শাঁকচুন্নি হয়ে থাক।
মতি স্থানত্যাগ করিতে চায়, কুসুমের সঙ্গে সে কথায় পারবে কেন? কুসুম তাহাকে রেহাই দেয় না। খপ করিয়া মতির হাতটা সে ধরিয়া ফেলে। মুখের কাছে মুখ লইয়া গিয়া অপলক চোখের তারা স্থির রাখিয়া কথাগুলিকে দাঁতে কাটিয়া কাটিয়া বলে, লজ্জা নেই তোর? এতবড় ধেড়ে মেয়ে তুই, লজ্জা নেই তোর? পেটে ভাত জোটে না, গয়লার মুখ্য মেয়ে তুই -–ছোটোবাবুর তুলনায় তুই ছোটলোক ছাড়া কী! অত তোর পাকামি কিসের? অমনি করিস বলেই তো বিরক্ত হয়ে ছোটোবাবু আর আসে না।
তারপর মতি কুসুমের হাত দেয় কামড়াইয়া। তাহাকে ছাড়িয়া দিয়া দংশিত হাতখানা ঘুরাইরা ফিরাইয়াকুসুম দাতের দাগগুলি ভালো করিয়া দ্যাখে।
কামড়ালি! আমাকে তুই কামড়ালি! দাঁড়া তোর আমি কী করি দ্যাখ।
কী করিবে? কুসুম তাঁহার কী করিবে? বুক দুরু দুরু করে মতির। ছোট বাবুকে যদি বলিয়া দেয়!
মতির মনে হয়, সে কুসুমের হাত কামড়াইয়া দিয়াছে শুনিলে ছোটোবাবু ভয়ানক রাগ করিবে।
খানিক পরেই সে কুসুমের আশেপাশে ঘোরাফিরা আরম্ভ করিয়া দেয়। একসময় সাহস করিয়া বলে, লেগেছে বউ? দেখি?
কুসুমের ক্ষমা নাই। সে ভাঙাইয়া বলে, লেগেছে বউ? কামড়ে দিয়ে নাকামি করতে এলেন।
মতি দাওয়ায় আসিয়া খুঁটি ধরিয়া দাঁড়ায়। ভাবে, বউ কী ভীষণ মেয়ে। ও ঠিক বলে দেবে।
পিসির ঘরে খোলা দরজা দিয়া পিসিকে দেখা যায়। পিসির আজকাল কথা বন্ধ হইয়া গিয়াছে। কথা বলিতে গেলে গলায় ফ্যাসফ্যাস আওয়াজ হয় মাত্র, কিছুই সে বলিতে পারে না। মতিকে দেখিয়া সে হাতের ইশারায় তাহাকে কাছে ডাকে। মাথা উঁচু করিয়া বারবার ব্যাকুলভাবে মুখের ফাঁকে আঙুল ঢুকাইয়া পিপাসা জানায়। দেখিতে পাইয়াও মতি কিন্তু অনেকক্ষণ নড়ে না।
বলে, যাইগো যাই-অত ব্যস্ত কেন?
মোক্ষদা জিজ্ঞাসা করে, কে ডাকে লো মতি?
পিসি। জল খাবে।
০৪. এবার কার্তিক মাসে পূজা
এবার কার্তিক মাসে পূজা। সেনদিদির সর্বাঙ্গে ব্রনগুলি পাকিয়া উঠিতে উঠিতে গ্রামের পূজার উৎসব শুরু হইয়া গেল। উৎসব সহজ নয়, গ্রামের জমিদার শীতলবাবুর বাড়ি তিনদিন যাত্রা, পুতুলনাচ, বাজি পোড়ানো, সাতগাঁ মেলা-পূজা তো আছেই। গ্রামবাসীর ঝিমানো জীবন প্রবাহে হঠাত প্রবল উত্তেজনার সঞ্চার হইয়াছে, কেবল শশী এবার সেনদিদিকে লইয়া বড় ব্যস্ত।
যাত্রা আরম্ভ হয় সপ্তমীর রাত্রে। যাত্রার দল তার আগেই গ্রামে হাজির হইয়া যায়। বায়না দিবার সময় শীতলবাবু অধিকারীকে বলিয়া দেন, দল নিয়ে দু-একদিন আগেই। আসবে বাপু, এক রাত্রি বেশ করে ঘুমিয়ে রাস্তার কষ্ট দূর করে অভিনয় করবে।
এবার যে-দলকে বায়না দেওয়া হইয়াছিল সে-দল এ-অঞ্চলের নয়। বিনোদিনী অপেরা পার্টির আদি আস্তানা খাস কলিকাতায়। বাজিতপুরের মথুরা সাহার ব্যবসা উপলক্ষে কলিকাতা যাওয়া-আসা আছে। কিছুদিন আগে ছেলের বিবাহে এই দলটি সে কলিকাতা হইতে ভাড়া করিয়া আনিয়াছিল। লোকমুখে দলের প্রশংসা শুনিয়া শীতলবাবু সেই সময় বায়না দিয়া রাখিয়াছিলেন।