সে একরকম চলিয়াই আসে। বাড়ির বাহিরে গিয়া গতি শ্লথ করিয়া দাঁড়ায়। মনে পড়ে সেনদিদির ভীরু কাতর চাহনি, একান্ত নির্ভরতা। শশী আবার ফিরিয়া যায়। বলে, ওটা যে গুটি-বসাবার ওষুধ, সাতদিন আগে ও ওষুধটা দিয়েছিলাম, আপনি জানতেন না?
যামিনীর মুখ কয়েকদিনে সম্ভবত দুশ্চিন্তাতেই শুকাইয়া পাংশু হইয়া গিয়াছে। সে চোখ মিটমিট করিয়া বলে, আমি কবরেজ মানুষ, তোমাদের ওষুধের আমি কী জানব ভাই? আমি তো কিছুই জানি না।
জানেন না তো আমায় না বলে ওষুধ খাওয়ালেন কেন? আপনিই মারবেন ঠাকুর্দা সেনদিদিকে। গুটি পাকছে, এখন আপনি খাইয়ে দিলেন গুটি-বসানোর ওষুধ?
যামিনী কথা কয় না।
শশী একটু নরম হইয়া বলে, বড়ো অন্যায় করেছেন ঠাকুর্দা, আর যেন এমন করবেন না কখনও।
যামিনী বলে, আমার একটা ওষুধ খাইয়ে দেবে শশী? তাড়াতাড়ি যাতে গুটি পাকে?
শশী তৎক্ষণাৎ সন্দিগ্ধ হইয়া বলে, খাইয়েছেন না কি কিছু? আপনার ওষুধ?
নাঃ, আমার ওষুধ খায় না।
তার মানে চেষ্টা করেছিলেন খাওয়াবার?
উদভ্ৰান্ত যামিনী এবার খেপিয়া যায়।
যদি করে থাকি? হ্যাঁ হে শশী, যদি করেই থাকি? তোমার ওসব মদ আর সিরাপে আমি বিশ্বাস করি না বাপু চিকিৎসা হচ্ছে! এই যদি তোমার বসন্তের চিকিৎসা হয়, পুঁথিপত্র খালে ভাসিয়ে ঘরের ছেলে ঘরে গিয়ে বসো গে যাও!
বলিতে বলিতেই যামিনী সাহস হারায়ম তবু মরিয়ার মতো বলে, তুমি আর এসো না!
মাথা শশীও ঠিক রাখতে পারে না ; গোড়া থেকে আপনি যা সব কাণ্ড করছেন ঠাকুর্দা, পুলিশ ডাকলে আপনার দশ বছর জেল হয়।
যামিনী বিবর্ণ মুখে বলে, কী করলাম আমি চিকিৎসা হচ্ছে তোমার, আমি তো একটা বড়িও খাওয়াইনি আমার!
শশী আর কথা-কাটাকাটি করে না। এ পাগলের সঙ্গে ঝগড়া করিয়া লাভ কী?
এই কি কলহের সময় ঠাকুর্দা?
কলহ কে করছে বাপু!
জ্ঞান হইলে যামিনী কবিরাজের বউ বলে, ঘরে কে, শশী? কার সঙ্গে কথা কইছ? — চোখে সে দেখিতে পায় না, চোখদুটি বন্ধ হইয়া গিয়াছে। যামিনী ঘরে আসিয়াছে শুনিলে উতলা হইয়া ওঠে, ওকে যেতে বলো শশী, যেতে বলো ওকে, আমাকে ও বিষ খাইয়ে মারবে- যাও না তুমি এ ঘর থেকে, চলে যাও না।
যামিনী চলিয়া গেলে বলে, বাঁচব তো শশী?
বাঁচবে বইকী।
সেনদিদি খুশি হয়। খানিকক্ষণ চুপ করিয়া পড়িয়া থাকে। শশী কি জানে না, কী অসহ্য তাহার যাতনা? সেনদিনির সহ্যশক্তি দেখিয়া বিস্ময় মানে শশী। নালিশ নাই, কাতরানি নাই, মাঝে মাঝে শুধু জিজ্ঞাসা করে বাঁচিবে কি না।
সেনদিদি বলে, এত ঘাঁটাঘাঁটি করছ, তোমার তো ভয় নেই বাবা?
কিসের ভয়? ছমাস আগে টিকে নিয়েছি।
তখন সেনদিদি বলে, ধরতে গেলে তুমি তো আমার ছেলেই। পেটের ছেলের চেয়ে তোমাকে বেশি ভালোবাসি শশী।
কথাটা শশীকে বিচলিত করিয়া দেয়। সেনদিদি যে তাকে ভালোবাসে সে তা জানে বারো বছর বয়স হইতে। কথাটা বলিবার ভঙ্গি তাহাকে অভিভূত করিয়া রাখে। কেমন একটা বালকত্বের অনুভূতি হয় এক অসুস্থা গ্রাম্য নারীর আবেগপূর্ণ কথায়। পেটের ছেলের চেয়ে ভালোবাসে? একথার অর্থ কী? সেনদিদির তো ছেলেমেয়ে হয় নাই কখনও।
একদিন সেনদিদির শিয়রে সারারাত জাগিয়া ভোরবেলা বাড়ি ফেরার সময় বাড়ির সামনে শিউলিগাছটার তলায় মতিকে শশী ফুল কুড়াইতে দেখিল। শশী যায় না বলিয়া মতি বুঝি ব্যাপার বুঝিতে আসিয়াছে!
শিউলি গাছটা ঝাঁকিয়া ফুল ঝরাইয়া দিয়া শশী জিজ্ঞাসা করিল, তুই কবে টিকে নিয়েছিলি রে মতি?
টিকে নিইনি তো!
নিসনি! কেন, টিকে নিতে কী হয়েছিল? দাঁড়া আজ তোদের বাড়িসুদ্ধ সকলকে টিকে দিয়ে আসব। পাড়ায় বসন্ত হয়েছে খবর রাখিস?
মতি অবিশ্বাসের হাসি হাসিয়া বলিল, টিকে নিলে কী হবে? মা শেতলার কৃপা হবার হলে হবেই গো ছোটোবাবু, হবেই।
তোর মাতা হবে।
শিশিরে একপশলা বৃষ্টির মতো চারিদিক ভিজিয়া আছে। মতির বিবর্ণপাড় শাড়ি আধভেজা কাপড়ের মতো কোমল দেখাইতেছিল। শশীর মনে হয় শাড়ির নমনীয় স্পর্শে মতি ভারি আরাম পাইতেছে। সকালবেলা রাতজাগা চোখে মতিকে যেন তার বয়সের চেয়ে অনেক বড় মনে হইতে লাগিল। ওকে দেখিতে দেখিতে সকালবেলা বিড়ি টানার আলস্য আরও মিষ্টি লাগিল শশীর।
মতি বলিতেছিল, বউ বলে আপনি সায়েব মানুষ, ঠাকুর-দেবতা মানেন না। সত্যি ছোটোবাবু?
না, সত্যি নয়। ঠাকুর-দেবতা খুব মানি।
শুনিয়া মতি যেন স্বস্তি পাইল।
বউ আপনার নামে যা-তা বলে।
অ্যাঁ? কী বলে?
মতি মুচকাইয়া হাসিল, কত কী বলে।
শশী হাসিয়া বলিল, তুইও তো বলিস মতি। পরাণের বউ হয়তো তোর কাছ থেকেই বলতে শিখেছে।
মতির মুখ শুকাইয়া গেল।
আমি আপনার নামে বলি। আমি যদি আপনার নামে কিছু বলে থাকি আমার যেন ওলাউঠা হয়। হয়–হয়–হয়, তিন সত্যি করলাম, ভগবান শুনো।
শশী অবাক হইয়া বলিল, তুই তো আচ্ছা রে মতি! সকালবেলা ফুল তুলতে তুলতে ওলাউঠার নাম করছিস!
মতি এবার রাগ করিয়া বলিল, আমার যেন হয়!
রোদ উঠিলে মতি বাড়ি গেল। শশী ভাবিল এমন গেঁয়ো স্বভাব, দেখতে তো গেঁয়ো নয়!
আর মতি ভাবিল, শেষের দিকে ছোটোবাবু আমাকে কী করে দেখছিল? আমাকে দেখতে দেখতে কী ভাবছিল ছোটোবাবু?
হারু ঘোষের বাড়ির সামনে বেগুনগাছগুলি এমন সতেজ। কয়েকটা গাছে কচি কচি বেগুনও ধরিয়াছে। বড় ঘরের পাশ দিয়া পিছনের মাঠে তাকাইলে অনেক দূরে কুয়াশা দেখা যায়। দূরত্বই যেন ধোয়াটে হইয়া আছে, কুয়াশা মিছে। মতি তৃপ্তিবোধ করে। সকালবেলার সোনালি রোদে তাহার চোখের সীমানার গ্রামখানি দেখিতে অপূর্ব হইয়া উঠিয়াছে বলিয়া নয়। প্রকৃতিকে, তাদের এই গ্রামের প্রকৃতিকে, মতি এতবেশি করিয়া চেনে যে আকাশের রামধনু ছাড়া তাহার চোখ তাহার মন কোথাও রঙ খুঁজিয়া পায় না। নাকের সামনে কচি কিশলয়ের মৃদু হিদোল কোন কাঁচা মনকে দোল দেয় কে জানে, মতির মনকে দেয় না। সর্বাঙ্গের শুভ্রতায় তালগাছের রহস্যময় ছায়া মাখিয়া মাখিয়া তালপুকুরের গভীর কালো জলে হাসঁ সাঁতার দেয়, তাদের গায়ে ঠেকিয়া লাল ও সাদা শাপলাগুলি জলে ডুবিয়া ভাসিয়া ওঠে, চারিদিকের তীর ভরিয়া কলমিশাকের ফুলগুলি বাতাসে যেন কেমন করিতে থাকে। আকাশে ভাসে উজ্জ্বল সাদা মেঘ আর বন্য কপোতের ঝাঁক। শালিখ পাখি উড়িবার সময় হঠাৎ শিস দেয়। অল্প দূরে কাতৌরা পাখির পাঠশালা বসে। বাতাসে থাকে কত ফুল, কত মাটি, কত ডোবার মেশানো গন্ধ।