গায়ের উজ্জ্বল রঙ লাল হইয়া অনম্ভের রঙের সঙ্গে মিশিয়া গিয়াছে, সারা গায়ে আরও সব অস্পষ্ট চিহ্ন, শশী যা চেনে। শশীর মুখ শুকাইয়া গেল। শরতের গোড়ায় এ রোগ সে-দিদি পাইল কোথায়। গাউদিয়া গ্রামে, কলিকাতা শহরে, দেশে বিদেশে কোথাও শশী যার মতো রূপসী দেখে নাই, শুধু রূপের জন্যই হয়তো যে মিথ্যা কলঙ্ক কিনিয়াছে, এ কী রোগ ধরিয়াছে তাহাকে?
শশীর ডাক শুনিয়া যামিনী কবিরাজের বউ চোখ মেলিয়া তাকাইয়া কাঁদিতে কাঁদিতে বলিল, তুমি এতদিনে এসেছ শশী? আমি যে মরতে বসেছি শশী? কী অসুখ করেছে কিছু জানি না, জ্বরে অচৈতন্য হয়ে থাকি, গায়ের ব্যথা সইতে পারি না–
আমি খবর পাইনি সেনদিদি।
কাকে দিয়ে খবর পাঠাব, কেউ কি আসে আমার কাছে!
সেনদিদি চোখ মেলিতে পারে না, চোখের কোণ দিয়া জল গড়াইয়া পড়ে। শশী বিছানায় বসে, সেনদিদির গায়ের তাপ পরীক্ষা করে, কী করিবে ভাবিয়া পায় না। যামিনী অসুখের কথা গোপন করিবার চেষ্টা করিয়াছিল, এ পর্যন্ত চিকিৎসারও হয়তো কোনো ব্যবস্থা হয় নাই। আজকাল তাহার কী হইয়াছিল, সেনদিদির খবর লইত না কেন? এই মলিন দুর্গন্ধ চাদরে আজ কতদিন না-জানি তাহর সেনদিনি বিনা-চিকিৎসায় পড়িয়া আছে, এতটুকু সেবা করিবারও কেহ থাকে নাই। শশী কিছু বুঝিতে পারে না। যে রূপের জন্য পৃথিবীর লোক উন্মাদ, স্ত্রীর যে সৌন্দর্য মানুষ তপস্যা করিয়া পায় না, যামিনী তাই পাইয়াছে। বুড়া বয়সে সে তো স্ত্রীর দাস হইয়া থাকিবে। কীজন্য তাহার এই বিকৃত । নিষ্ঠুর অবহেলা? কে জানে, হয়তো সীতা আর হেলেন আর ক্লিওপেট্রার মতো যার অসাধারণ রূপ থাকে তাকেরিয়া খাপছাড়া কান্ডই ঘটতে থাকে জগতে!
খানিক পরে যামিনী ঘরে আসিল, মুখ ভার করিয়ী বলিল, এখনো তুমি বসে আছ শশী? আমি ভাবলাম তুমি বুকি চলে গেছ।
শশী বলিল, ঠাকুর্দা, বাইরে আসুন দিকি একবার। বাহিরে গিয়া বলিল, সেনদিদির অসুখ কি আপনি ধরতে পারেননি ঠাকুর্দা।
যামিনী কবিরাজ বলিল, হাসির কথা বললে বটে শশী, চল্লিশ বছর কবরেজি করছি, তিনটে জেলায় যামিনী কবরেজের নাম জানে না এমন লোক নেই, আমায় তুমি শুধোচ্ছ রোগ ধরতে পারিনি? একনজর তাকালে রোগ নির্ণয় হয়। ওঁয়ার হয়েছে ম্যালেরিয়া।
ম্যালেরিয়া নয়, ঠাকুর্দা, বসন্ত। —শশী বলিল।
হ্যাঁ, বসন্ত। শরৎকালে বসন্ত!—বলিল যামিনী কবিরাজ।
বলিল বটে, যামিনীর মুখে কালি পড়িয়াছে কিসের? শশীর কাছে যামিনী যেন অভিমান করিতেছে, একটা পাণ্ডুর ভয় আর কালো চিন্তার রাশিকে গোপন করিবার অভিনয়। শশী কড়াসুরে বলিল, আমি সেনদিদির চিকিৎসার ভার নিলাম ঠাকুর্দা। ছি, ছি, আজ পর্যন্ত কিছুই করেননি?
খায় নাকি আমার ওষুধ?
শশী ঘরে গিয়া বসিল। কী ভাবিয়া যামিনীও ঘরের মধ্যে গিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। শশী দারুণ বিপন্ন বোধ করিতেছিল। আর বিষন্নতা। কয়েকদিন আগে সাতগাঁয়ে সে একটি বসম্ভের রোগী দেখিতে গিয়াছিল। তাহাকে শশী বচাইতে পারে নাই। বাঁচাইবার চেষ্টাও সে করিতে পারে নাই, তাকে ডাকা হইয়াছিল একেবারে শেষমূহুর্তে। শেষপর্যন্ত রোগীর চিকিৎসা করিয়াছিল সাতগাঁর কবিরাজ যামিনীর পূর্বতন ছাত্র ভূপতিচরণ। শশীর হঠাৎ মনে পড়িয়াছে, সেই রোগীটি মারা যাইবার পর যামিনী হাসিয়া বলিয়াছিল, আমার ছাত্র যাকে ছাড়পত্র লিখে দিল তাকে বাঁচাবে শশী- আমাদের শশে?
শশী প্রাণ দিয়া সেনদিদির চিকিৎসা ও সেবা আরম্ভ করিল। অন্য রোগীরা তাহাকে ডাকিয়া পায় না। বাড়িতে কারও জ্বরজ্বালা হইলে চোখের পলকে পরীক্ষা শেষ করিয়া ওষুধ দেয়,-না বলিলে আর খবর নেয় না। বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজন সকলকে সে অবহেলা করে। যায় না হারু ঘোষের বাড়ি, বিনা কাজে অথবা মতিকে ইনজেকশন দিতে। কুসুম ভাবিল, শশী বুঝি রাগ করিয়াছে। তালবনের তালপুকুরে পদ্ম তুলিতে গিয়া মতি আশা করিতে লাগিল, ছোটোবাবু আজ নিশ্চয় আসবে। ছোটোবাবুকে একডালা পদ্ম দেব। কিন্তু কুসুমের মনে শশীর উপর রাগ কমিল না। মতির পদ্মফুলের বীচি দিয়া রাঁধা হইল তরকারি।
শুধু সেনদিদির ব্যবস্থা করিতে হইলে শশীর হয়তো চারদিকে তাকানোর সময় পাইত। চিকিৎসা আরম্ভ করিয়া এ-বাড়িতে গোপালের এবং ও-বাড়িতে যামিনীর উপদেশ, সমালোনা ও বাধাদানের বহরে সে বিপন্ন ও বিব্রত হইয়া রহিল। চিকিৎসায় ওদের শ্রদ্ধা নাই, এই কথাটা এমনিভাবে প্রকারান্তরে তাহাকে জানাইয়া দেওয়া হইতেছে। কিন্তু চিকিৎসার আর কোনো ব্যবস্থাও তো নাই। ভালো হোক মন্দ হোক, তার সাকে ছটিয়া ফেলার মধ্যে যুক্তি আছে কোনখানে? আমার ওষুধ খায় না, বলিয়া যামিনী নিজে চিকিৎসা করিতে রাজি নয়,-ওরা মারিয়া ফেলিতে চায় নাকি সেনদিদিকে? তাই বা কেন চাহিবে? তা ছাড়া যামিনীর এই লজ্জাকর পাগলামিতে গোপাল এভাবে সাহায্য করিতেছে কেন, তার স্বার্থ কী?
ব্যাপার যত রহস্যময়ই হোক, শশী একা সেন দিদির তিনটি যমের সাথে লড়াই করিতে লাগিল।
যামিনীকে সে জিজ্ঞাসা করে, বড় গোল শিশির ওষুধ কী হল ঠাকুর্দা?
যামিনী বলে, তিন দাগ ছিল না? খাইয়ে দিয়েছি। কী যে সব ওষুধ তোমার শশী,– সব ওষুধ হয় মদ, নয় সিরাপের গন্ধ!
শশী সভয়ে বলে, খাইয়ে দিয়েছেন? গোল শিশির ওষুধটা খাইরে দিয়েছেন?
তা দিলাম বইকী? ছটফট করছিল দেখে ভাবলাম, তোমার রুগী তোমার ওষুধ, দিই খাইয়ে!
শশী রাগ করিয়া বলে, রোগী আমার নয় ঠাকুর্দা, আমি চললাম। আপনার যা-খুশি করুন।