শশী একটু লজ্জা পায়। মরণাপন্ন পিসিকে দেখিয়া যাওয়ার কথা প্রায়ই তাহার মনে থাকে না। পিসির মরণ এতদূর সুনিশ্চিত যে তার সম্বন্ধে করিবার এখন আর কিছুই নাই। তাই কি শশী ভুলিয়া যায় আজো পিসি বাঁচিয়া আছে?
বড় বাঁচিবার সাধ পিসির।
পিসি মরিলে যে কাঠ দিয়া তাহাকে পোড়ানো হইবে, তাহার ঘরেরই অর্ধেকটা । জুড়িয়া সেগুলি সাজাইয়া রাখবা হইয়াছে। মাথার দিকে ঘরের কোণে দাড়-করানো পাটকাঠির বোঝা হইতে পিসি এখনো পাটের গন্ধ পায়; এক আঁটি পাট ধরাইয়া পিসির মুখাগ্নি করিকে পরাণ। মাথার চুল পিসির অর্ধেক ঝরিয়া গিয়াছে, দেহের লাল চামড়ার তলে মাংস আছে কিনা বোঝা যায় না। পিসি তবু বাঁচিবেই।
চুপিচুপি সে শশীকে বলে, ও বাবা শশী, বই দেখে ওষুধ দিও বাবা, দামি ওষুধ দিও। দামের জন্য ভেবো না, বাবা সেরে উঠি, ওষুধের দাম তোমায় আমি মিটিয়ে দেব।
বলে, আমার যা-কিছু আছে সব তোমাকে দিয়ে যাব, তুমি ভালো করে আমায় চিকিচ্ছে কর।
তবু শশী প্রায়ই ভুলিযা যায় পিসি বাঁচিয়া আছে।
ইনজেকশন দিবার সময় প্রত্যেকবার শশী মতিকে বলিয়াছে, আর তোর জ্বর হবে না মতি।
শশীর আশ্বাস সত্য হইলে এ বছরের মতো মতিকে ম্যালেরিয়া ছাড়িয়াছে। ওদিকে যামিনী কবিরাজের বউ, শশী যাহাকে সেন দিদি বলিয়া ডাকে, পড়িয়াছে জ্বরে।
যামিনী বিখ্যাত কবিরাজ। বহু দূরবর্তী গ্রামে তাহাকে চিকিৎসার জন্য ডাকা হয়। সিদ্ধির পাতা মিশাল দিয়া যামিনী যে চব্যনপ্রাণ প্রস্তুত করে তাহা নিয়মিত সেবন করিলে বৃদ্ধের দেহে যুবার ন্যায় শক্তির সঞ্চার হয়। মরিয়া গেলেও যামিনীর মকরধ্বজ রোগীর দেহে জীবন আনিয়া দিতে পারে। তারপর এই জীবনকে ধরিয়া রাখিবার জন্য যামিনীর আদি ও অকৃত্রিম আবিষ্কার মহাকপিলাদি বটিকা সেবন করা বিধেয়। এই বটিকা প্রস্তুত করিতে তিন রাত্রি সময় রাগে। ইহা কখনও প্রস্তুত হইয়া থাকে না। কারণ, তৈরি করিয়া রাখিলে এই মহাতেজস্কর ঔষধের গুণ সূর্যরশ্মি আকর্ষণ করিয়া লয়। সুতরাং যামিনীর মকরধ্বজের তেজে মৃতদেহে জীবন সঞ্চার হইলেও মহাকপিলাদি বটিকার অভাবে প্রাণটুকু যে সবসময় টিকিয়া থাকে, এমন নয়। কিন্তু সে অপরাধ কি যামিনীর? রোগীর কপাল! মহাকপিলাদি বটিকাতো প্রস্তুত নেই। রোগীকে না হয় বাঁচালাম, তারপর তিনদিন টেকাব কী দিয়ে?
মৃতকে যামিনীর এক লহমার জীবন দান কেহ কখনও দ্যাখে নাই। তবু লোকে বিশ্বাস করে। একজন দুজন নয়, অনেকে!
যামিনী কবিরাজের বউ কিন্তু কখনও স্বামীর ওষুধ খায় না। অসুখ হইলে এতকাল সে বিনা চিকিৎসাতেই ভালো হয়েছে, এবার জ্বরে পড়িয়া শশীকে ডাকিয়া পাঠাইলো।
গোপাল তখন বাড়িতে ছিল। শশীর হইয়া সে বলিয়া দিল, বলগে, যাচ্ছেতারপর শশীকে যাইতে নিষেধ করিয়া দিল।
শশী বলিল, কেন, যাব না কেন?
গোপাল বলিল, কবে তোমায় বুদ্ধি পাকবে, ভেবে পাই না শশী।
শশীও তাহা ভাবিয়া পায় না। সে চুপ করিয়া রহিল।
তখন গোপাল বলিল, যামিনী খুড়ে অত বড় কবরেজ, সে থাকতে ডেকে পাঠানোর মানেটা বোঝ?
শশী বলিল, আজ্ঞে না।
যুবতী স্ত্রীলোক, নানারকম কুৎসাও শুনতে পাই—
গোপালের মুখে এই কথা? লজ্জায় শশী সচকিত হইয়া গেলর। মৃদুস্বরে সে বলিল, এসব আপনার বানানো কথা বাবা।
গোপাল রাগ করিল না, বলিল, তোমার যে কী হয়েছে আজকাল বুঝতে পারি না শশী। তোমার ভালোর জন্যে একটা কথা কইলে তুমি আজকাল তর্ক জুড়ে দাও। সংসারে মানুষকে ভেবেচিন্তে কত সাবধানে চলতে হয় সে জ্ঞান তোমার এখনো জনেনি। এই তোমার উঠতি পসারের সময়, এখনই একটা বদনাম রটে গেলে-এও কি তোমায় বলে দিতে হবে? তুমি চিকিৎসার ভার নিলে বলাবলি করবে না-লোকে যামিনী কবরেজ থাকতে তুমি ছেলেমানুষ তোমার কেন আত মাথাব্যথা? সবার বাড়িতে মেয়েছেলে থাকে, এর পর কে আর ডাকবে তোমায়?
শশীর রাগ হইতেছিল। কিন্তু শৈশব ও কৈশোরের এই মনটিকে ভয় করা তাহার সংস্কারে দাঁড়াইয়া গিয়াছে, গোপালের তীক্ষ্ণ অপলক দৃষ্টিপাতে সে চোখ নামাইয়া লইল। গোপাল আবার বলিল, যামিনী খুড়োর ইচ্ছেও নয় তুমি ওদের বাড়ি যাও।
শশীর নীরবতায় গোপাল খুশি হইয়াছে। বয়স্ক উপযুক্ত সন্তানকে বশ করা, জগতে এতবড় জয় আর নাই। আজকাল নানা ছোট-বড় ব্যাপারে শশীর সঙ্গে গোপালের সংঘর্ষ বাধিতেছিল, কলহ বিবাদ নয়,-তক ও মতান্তর, আদেশ ও অবাধ্যতার বিরোধ। আজ তবে শশী বুঝিতে পারিয়াছে সাংসারিক বুদ্ধিতে বাপের চেয়ে সে ঢের বেশি কাঁচা, গোপাল এখনো তাহাকে পরিচালনা করিতে পারে।
গোপাল আরও অনেক কথা বলিল, শশী নীরবে শুনিয়া গেল। শেষে তাহার কঠিন মুখের ভাব দেখিয়া আর কিছু বলা ভালো না মনে করিয়া গোপাল থামিল।
খাওয়াদাওয়ার পর শশী গেল যামিনী কবিরাজের বাড়ি।
শশীকে দেখিয়া যামিনী কবিরাজ খুশি হইল না। সদর বাড়তে সে তখন মুখে মুখে দুটি ছাত্রকে ওষুধের প্রস্তুত-প্রণালী শিখাইতেছিল, পাশের চালাটায় বুঝি সিদ্ধ হইতেছিল পাঁচন, গন্ধে চারিদিক ভরিয়া দিয়াছে। শশীকে দেখিয়া যামিনী চশমা খুলিয়া বলিল, কী মনে করে শশী? বোসো।
শশী বলিল, সেনদিদির অসুখ শুনলাম ঠাকুর্দা, একবার দেখা করে যাই।
অসুখ?-যামিনী হাসে, কার কাছে শুনলে? জ্বর বুঝি হয়েছিল একটু কাল, না রে কুঞ্জ? আজ অসুখ কোথা!
তবে বুঝি কোনো কাজে ডেকেছেন, বলিয়া শশী ভিতরে গেল।
সেনদিদি শুইয়া ছিল, আচ্ছন্ন অসুস্থ, মৃতকল্প সেনদিদি।