হারু নাই, হারুর ছেলে পরাণ বাপের মতো চালাকও নয়, গোয়ারও নয়। গাওদিয়ার গোপ-সমাজ মতির বিবাহের জন্য আবার একটু ব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছে। পরাণকে তাহারা অনেক কথা বুঝায়। বলে গায়ের মেয়ে গায়ে থাকাই তো ঠিক। জানাশোনা ঘরে দিলে মেয়ে সুখে থাকিবে। দুধ-বেচা গোপের ঘরেও তো বোনকে দিবার কথা তাহারা বলিতেছে না, সুদেবের ঘর তো বনেদি ঘরের মতো। কেন দোমনা হচ্ছিস বল তো পরাণ? বাজিতপুরের ছেলেটা তো ফসকে গেছে।
সুদেবের সঙ্গে মতির বিবাহ? রসালো ফলের মতো অমন কোমল রঙ যে মতির, প্রতিমার মতো অমল নিখুঁত মুখ? প্রস্তাবটা পরাণের পছন্দ হয় না। কিন্তু অত লোকের কাছে স্পষ্ট না বলিবার মতো মনের জোরও তাহার নাই। নিমরাজি হইয়া সে বলিয়াছে, বাড়িতে আর শশীর মত থাকিলে সে আপত্তি করিবে না।
শশীর মতামতের প্রশ্নটা তাহারা পছন্দ করে নাই। নিতাই হাসিয়া বলিয়াছে, ছোটোবাবু লোক ভালো। কিন্তু নিজের সমাজে হিতৈষী গণ্যমান্য লোক থাকতে ছোটোবাবুকে মুরুব্বি ঠাওরালে পরাণ? ঘরের কথায় পরকে ডাকলে?
আজ একজন বলিয়াছে, ছোটোবাবু হরদম আসেন যান, না বটে?
একথাটা পছন্দ করে নাই পরাণ দুপক্ষের পছন্দ শেষপর্যন্ত কিসে গিয়া ঠেকিত বলা যায় না। কিন্তু হারুর আকস্মিক মৃত্যুর পর পরাণ বড় দমিয়া গিয়াছিল। কলহ না করিয়া বাড়িতে অসুখের ছুতা দিয়া সে উঠিয়া আসিয়াছে।
মতির জ্বর কিন্তু কমিয়া গিয়াছে। বর্ষার গোড়ার দিকে তাহাকে ম্যালেরিয়ায় শশীর দামি কুইনাইন জ্বরটা একেবারে ঠেকাইতে পারে নাই। এবার গা ষ্টুড়িয়া কয়েকবার তাহাকে ওষুধ দিয়া শশী আশ্বাস দিয়াছে, আর জ্বর হইবে না। জ্বরে ভুগিয়া মতির বিশেষ ক্ষতি হইয়াছে মনে হয় না। ম্যালেরিয়া ধরিবার আগে হঠাৎ সে মোটা হইতে আরম্ভ করিয়াছিল। মাঝে মাকে জ্বরে পড়িয়া এটা বন্ধ হইয়া গিয়াছে। মতির সুন্দর গড়নটি চর্বিতে ঢাকিয়া গেলে বড় আপসোসের কথা হইত।
এখনো প্রতি সপ্তাহে মতিকে শশী একটা করিয়া ইনজেকশন দেয়। সকালে বাড়িতে যে কজন রোগী আসে তাদের ব্যবস্থা করিয়া, কালো ব্যাগটি হাতে করিয়া সে যখন হারু ঘোষের বাড়ি যায়, হয়তো তখন বেলা হইয়াছে, সমস্ত উঠান ভরিয়া গিয়াছে রোদে। মতির ভীত শুকনা মুখ দেখিয়া শশী হাসিয়া বলে, এতবার দিলাম এখনো তোর ভয় গেল না মতি? কোন হাতে নিবি আজ? স্পিরিট দিয়া ঘসিলে মতির বাহুতে ময়লা ওঠে। শশী বলে, বড় নোংরা তুই মতি, -গায়ে সাবান দিতে পারিস না?
ইনজেকশন দিয়া শশী দাওয়ায় বসে। পরাণ বলে, একটা পরামর্শ আছে ছোটোবাবু। বিষয়টা মতির বিবাহ-সংক্রান্ত শুনিয়া শশী জাকিয়া বসিয়া একটা বিড়ি ধরায়। ছেলের ইশারায় মোক্ষদা সরিয়া আসে কাছে। বুঁচিও আসিয়া ছেলে-কোলে কাছে দাঁড়ায়।
কুসুমকে দেখিতে না পাইয়া শশী মনে-মনে আশ্চর্য হয়। পুধের ভিটার ঘরখানার ছায়া ঘরের মধ্যেই সঙ্কুচিত হইয়া গিয়াছে। পরাণের কথা শুনিতে শুনিতে প্রতিমুহুর্তে সঞ্চয় করিয়া কুসুম হঠাৎ বাহির হইয়া আসিবে,পরমাত্রীয়দের এই সভার একপ্রান্তে দাঁড়াইয়া থাকিবে পরের মতো।
তার সাড়া পাইয়া কুসুম যে কলসিটা তুলিয়া ঘাটে চলিয়া গিয়াছিল, শশী তাহা কেমন করিয়া জানিবে? পরাণের বক্তব্য শেষ হইয়া আসিলে কুসুম ভিজা কাপড়ে উঠানের রোদে পায়ে দাগ আকিয়া পুবের ঘরের ছায়ার মধ্যে ডুবিয়া যায়। রান্নাঘরের পোড়া ডালের গন্ধে চারিদিক ভরিয়া যাওয়ার পর ঘর হইতে সে আর বাহির হয় না।
মোক্ষদার রূঢ় বাক্যস্রোতে তারপর কিছুক্ষণের জন্য মতির বিবাহের সমস্যা ভাসিয়া যায়। রান্নাঘরের খোলা দরজা দিয়া অপরাধী ভালের হাড়িটা উঠানে আসিয়া আছড়াইয়া পড়িতে আজ যে আবার ও-প্রসঙ্গে উঠিবে সে সম্ভাবনা থাকে না। শশী ভাবে, সকলের কাছে কত বকবকিই বউটা না জানি শুনিবে!
মোক্ষদা, বুঁচি, মতি সকলেই হৈ হৈ করে। ও-ঘর হইতে মুমূর্ষ পিসি চেঁচায়, কী হল রে বুঁচি? কী হল রে মতি? চুপ করিয়া থাকে শশী। সকলকে চুপ করাইতে গিয়া পরাণহরা আরও বাড়ায়। কিন্তু কী নির্বিকার কুসুম – রাগের মাথায় ডালের হাড়িটা যে উঠানে ছুড়িয়া দিয়াছে, সে হাসিমুখে বাহিরে আসে। দাঁড়ায় শশীর সামনে। বলে, জ্বর এল নাকি, দেখুন দিকি ছোটোবাবু।
শশী নাড়ি ধরিয়া বলে, জ্বর আসেনি বউ।
মাথা ধরেছে যে ?
কতক্ষণ ধরে জলে ডুবিয়েছ তুমিই জানো, মাথার দোষ কী?
কুসুম মাথা নাড়িয়া বলে, উঁহু, আমার ঠিক জ্বর আসছে, আমি গিয়ে শুলাম। যা লো মতি, আজ তুই রাঁধবি যা।
কুসুম ঘরে গিয়া শুইয়া পড়ে।
কিন্তু শুইয়া কেন থাকিতে পারবে এই চঞ্চলা নারী? খানিক পরে উঠিয়া আসিয়া না বলিতেই পরাণকে এক ছিলিম তামাকে দিয়া সে অদূরে বসিয়া পড়ে। সুদেবের সঙ্গে মতির বিবাহে শশীর মত নাই শুনিয়া বলে, কেন গো ছোটোবাবু, সুদেব পাত্তর কী এমন মন্দ? পুরুষমানুষের আবার বয়েস—সতিন কাঁটা তো নেই? ঘরে পয়সা আছে লোকটার,–মেয়ে সুখে থাকবে।
শশী বলে, হারুকাকার অমত ছিল সেটা তো ভাবতে হবে বউ?
কুসুম বলে, তিনি সগ্যে গেছেন।
আর কিছু কুসুম বলে না। শশী তাহাকে বুঝাইবার চেষ্টা করে, সুদেব লোক ভালো নয়, মতির সঙ্গে সুদেবকে মানায় না। কুসুম বোঝে কি না কে জানে-মোক্ষদার খর দৃষ্টিপাতে মাথায় ঘোমটা একটু টানিয়া দিয়া নিশ্চল প্রতিমার মতো বসিয়া থাকে। শশী বাড়ি যাওয়ার জন্য উঠিলে সে আবার মুখ খোলে। বলে, পিসিকে একবার দেখে যান ছোটোবাবু, বুড়ি কাঁদতে নেগেছে।