নন নর্মযুক্তং বচনং হিনস্তি
ন স্তীষু রাজন ন বিবাহকালে
প্ৰাণাত্যয়ে সর্বধনাপাথরে
পঞ্চান্তান্যাহুর পাতকানি
তার মানে হল, পাঁচ অবস্থায় মিথ্যা বললে পাপ হয় না। পরিহাসে, মেয়েমানুষকে খুশি করায়, বিবাহকালে, প্ৰাণ সংশয়ে এবং সর্বস্ব নাশের সম্ভাবনায়। আপনি আমার সঙ্গে রাত্রিযাপন করলে আমাকে খুশি করবেন। কাজেই আপনার পাপ হবে না। এই কথায় মহারাজ যযাতি শৰ্মিষ্ঠার সঙ্গে রাত্রিযাপনে রাজি হলেন।
সুরেশ বাগচী বললেন, গল্পটা কেমন লাগল?
অনিল, অতসী কেউ কিছু বলল না। মহারাজ যযাতির কাজটা কি ঠিক হয়েছে?
অতসী বলল, ঠিক হয় নাই।
হ্যাঁ, ঠিক হয় নাই। ধর্মগ্রন্থে যাই থাকুক কোন অবস্থাতেই মিথ্যা বলা যায় না। বাবারা, এটা যেন মনে থাকে।
অনিল অসম্ভব ভীতু। কিন্তু বাবার চিঠি বুকে নিয়ে সে মিথ্যা বলতে পারছে না। তাকে সত্যি কথাই বলতে হবে। চিঠিটা কি ফেলে দেয়া ভালো না?
আলফা ইসুরেন্স কোম্পানি
আলফা ইসুরেন্স কোম্পানির হেড অফিস মতিঝিলে।
তাদের অফিস ছোট কিন্তু ব্যবসা ভালো। জাহাজের মালামাল ইন্সুরেন্স করাই এই কোম্পানির ব্যবসা। এই ধরনের ব্যবসায় বিশাল অফিস লাগে না। একটা টেলিপ্রিন্টার, আন্তর্জাতিক টেলিফোন লাইন, উপরের মহলের সঙ্গে ভালো যোগাযোগই যথেষ্ট। অল্পকিছু কাজ জানা লোকই যথেষ্ট। কোম্পানির মালিক জোবায়েদ সাহেব। অবাঙালি। ১৯৫০ সনে বিহার থেকে মোহাজের হয়ে বাবামার সঙ্গে ঢাকা এসেছিলেন। তখন তাঁর বয়স মাত্র একুশ বছর। সেই সময় তাঁদের পরিবারের সম্বল ছিল মায়ের আঠারো ভরি সোনার গয়না। মাত্র কুড়ি বছরের ব্যবধানে সেই বিত্ত ফুলে ফেঁপে একাকার হয়েছে। জোবায়েদ সাহেব আলফা ইসুরেন্সের একটা শাখা অফিস খুলেছেন করাচিতে। খুব সম্প্রতি লন্ডনেও একটা অফিস নেয়া হয়েছে। অফিস চালু হবার আগেই ঝামেলা লেগে গেল। তিনি ঠাণ্ডা মাথায় ঘটনাপ্রবাহ লক্ষ্য রাখছেন। এমনিতেই তার মাথা ঠাণ্ডা। এখন তা আরো অনেক ঠাণ্ডা হয়ে গেছে।
অফিসের কাজকর্ম নেই বললেই হয়। টেলিপ্রিন্টারে খাট খাট বেশ কিছুদিন হল শোনা যাচ্ছে না। আন্তর্জাতিক লাইন সব সময় ব্যস্ত। লাইন চাইলেই পাওয়া যায় না। গতকাল সারাদিন অপেক্ষা করে করাচীর লাইন পেলেন। তাও কথাবার্তা পরিষ্কার না। করাচী অফিসের নবী বখশ বলল, বাঙালি কুত্তাগুলোর খবর কি? কুত্তাগুলোর ল্যাজ সোজা হয়েছে?
জোবায়েদ সাহেব প্রসঙ্গ পাল্টে ব্যবসার কথা তুললেন। জানা গেল ব্যবসা মোটামুটি। খুব খারাপ না, আবার ভালোও না। নবী বখশ আবার বাঙালি প্রসঙ্গ তুলল, ইংরেজিতে যা বলল তার বঙ্গানুবাদ হচ্ছে— সব বাঙালি পুরুষগুলোর বিচি অপারেশন করে ফেলে দেয়া দরকার। বিচি ফেলে দিলেই এরা ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। বিচি গরম হওয়ায় এরকম করছে। গরম দেশে গরম বিচি ভালো না।
জোবায়েদ সাহেব চিন্তিত বোধ করছেন। পশ্চিমাদের মনোভাব এই হলে ঝামেলা মিটবে না। তারা বাঙালিদের যতটা তুচ্ছ করছে তত তুচ্ছ করার কিছুই নেই। বরং এরা জাতি হিসেবে ভয়ংকর। ইংরেজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এই বাঙালিগুলোই শুরু করেছিল। যাদের রাজ্যে সূর্য অস্ত যেত না তারা যে পালিয়ে বাঁচল তা গান্ধিজীর জন্যে না। চরকা কাটা, দেশি লবণ খাওয়া এগুলো ফালতু ব্যাপার। ব্রিটিশ সিংহ চরকা ভয় পায় না। ব্রিটিশ সিংহ ভয় পেয়েছিল–ক্ষুদিরাম মার্কা ছেলেগুলোকে।
বাঙালিগুলো মহাঅলস, একটু ভালো-মন্দ খেতে পারলে মহাখুশি, গল্প করার সুযোগ পেলে খুশি, রাজনীতি নিয়ে দুএকটা কথা বলতে পারলে আনন্দে আত্মহারা, নিজের বউ নিয়ে বেড়াতে যাবার সময় আড়চোখে অন্যের স্ত্রীকে একটু দেখতে পারলে মহা আনন্দিত। তবে এদের রক্তের মধ্যে কিছু একটা আছে। বড় কোন গণ্ডগোল আছে। মাঝে মাঝে এরা ক্ষেপে যায়। কিছু বুঝতে চায় না, শুনতে চায় না। সাহস বলে এক বস্তু যে এদের চরিত্রে নেই সেই জিনিস কোথেকে চলে আসে।
জোবায়েদ বুঝতে পারছে সামনের দিন পাকিস্তানিদের জন্যে ভালো না। শুধু ভালো না বললে কম বলা হবে, সামনের দিনগুলো ভয়ংকর। আশ্চর্যের ব্যাপার, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কেউ তা ধরতে পারছে না। এরা এখন মোটামুটি সুপ্ত। দেশ দখলে নিয়ে এসেছে। থানা পর্যায়ে সৈন্যবাহিনী পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। চলে এসেছে মিলিশিয়া, রেঞ্জার পুলিশ। ঢাকা শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছে কমান্ডো গ্রুপের সুশিক্ষিত সৈন্য। আরো আসছে। জাহাজ আসছে।
সিগন্যাল কোরের কর্নেল এলাহীর সঙ্গে জোবায়েদ সাহেবের সুসম্পর্ক। কর্নেল এলাহীর এক শালাকে তিনি লন্ডন ব্রাঞ্চের অফিসের দায়িত্ব দিয়েছেন। এলাহী সাহেব মাঝে মাঝে জোবায়েদ সাহেবের অফিসে কফি খেতে আসেন। গল্প-গুজব করে বিদেয় হন। ব্যাপারটা জোবায়েদের পছন্দ না, কারণ শহরের মুক্তিবাহিনী নামক গেরিলারা তৎপর হচ্ছে। কর্নেল এলাহী এখানে আগমন তাদের চোখে পড়তে পারে। অফিসে বোমা মেরে দেয়া বিচিত্র কিছু না। অবশ্যি জোবায়েদ সাহেব জানেন- গেরিলা তৎপরতা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় আনার এখনো কোন কারণ ঘটে নি। অল্পবয়েসী কিছু ছেলে-পুলে এই কাজটা করছে। গেরিলা জীবনের রোমান্টিক অংশটাই তাদের আকৃষ্ট করছে। তবে এটাকে হেলাফেলা করাও ঠিক না। যুদ্ধে অতি তুচ্ছ ব্যাপারও অবেহলা করতে নেই। ঘোড়ার নালের জন্যে পেরেক ছিল না বলে রাজত্ব চলে গেল। গল্পের রূপক অংশটি অগ্রাহ্য করা ঠিক না।