অতসী ভালো আছে তাহাকে সুপাত্রে সম্প্রদান করা আমার বড় দায়িত্বের একটি। তেমন সন্ধান পাইতেছি না। তাহার বড় মামা কলিকাতা হইতে পত্ৰ দিয়াছেন যেন আমি অতসীকে কলিকাতা নিয়া যাই। সেইখানে পাত্রের সন্ধান করিয়া বিবাহ দিবেন। আমি তাহাতে সম্মত হই নাই। অতসী এই দেশের মেয়ে। এই দেশে তাহার বিবাহ হইবে। এই বিষয়ে তোমার ভিন্ন মত থাকিলে আমাকে জানাইবে।
মোক্তার পাগলি মাঝে মধ্যে তোমার সন্ধানে আসে। কিছু দিন পূর্বে কয়েকটা পাকা কামরাঙ্গা নিয়া আসিয়াছিল। তোমাকে দিতে চায়। একজন পাগল মানুষের ভালবাসার এই প্ৰকাশ দেখিয়া আমার চোখে জল আসিয়া পড়িল। আমি অতসীকে বলিলাম যত্ন করিয়া সে যেন মোক্তার পাগলিকে চারটা ভাত খাওয়াইয়া দেয়। তাহাকে বারান্দায় পাটি বিছাইয়া খাইতে দেওয়া হইল। সে অনেকক্ষণ ভাত মাখাইয়া কিছু মুখে না দিয়া উঠিয়া চলিয়া গেল।
এই পাগল মানুষটি তোমার প্রতি যে ভালবাসা দেখাইল তাহা তুমি স্মরণ রাখিও। আরেকজন মানুষের কথা স্মরণ রাখিও যিনি তোমার প্রতি কোন ভালবাসা দেখাইবার সুযোগ পান নাই। তিনি তোমার মা। তোমার জন্মমুহূর্তেই তাহার মৃত্যু হইয়াছে। মায়েরা সন্তানের জন্যে অসীম ভালবাসা নিয়া আসেন। এই মা সেই অসীম ভালবাসার কিছুই ব্যবহার করিতে পারেন নাই। তাই বলিয়া মনে করিও না সেই ভালবাসা নষ্ট হইয়াছে। এই পৃথিবীতে সবই নশ্বর, কিছুই টিকিয়া থাকে না, কেবল ভালবাসা টিকিয়া থাকে।
যদি কখনো বড় বিপদে পড় ঈশ্বরকে স্মরণ করবে। সেই সঙ্গে তোমার মাকেও স্মরণ করবে। ইহাই আমার উপদেশ। পরম করুণাময় তোমার মঙ্গল করুন।
বাংলা রেস্টুরেন্ট
রেস্টুরেন্টের নাম কিছুদিন আগেও ছিল বাংলা রেস্টুরেন্ট।
এখন নতুন নাম। কায়দে আযম রেস্টুরেন্ট। সাইন বোর্ড ইংরেজি, উর্দু এবং বাংলায় লেখা। সবচে ছোট হরফ বাংলায়। বাঙালিরা এসব দেখছে। কিছু বলছে না। চুপ করে আছে। ছাবিবশে মার্চের পর সবাই অতিরিক্ত রকমের চুপ। রেস্টুরেন্টে ফ্রেমে বাধাই করা আছে বড় বড় অক্ষরে লেখা রাজনৈতিক আলোচনা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তার প্রয়োজন ছিল না। রাজনৈতিক আলোচনা কেউ করছে না। মনে হচ্ছে, এ বিষয়ে এখন কারো কোন আগ্রহ নেই।
অনিল কায়দে আযম রেস্টুরেন্টে নাশতা খেতে এসেছে। ভালোমতো খেয়ে নেবে, তারপর রওনা হবে টাঙ্গাইলের দিকে। বাস আছে নিশ্চয়ই। পত্রিকায় বার বার লেখা হচ্ছে- দেশের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দুষ্কৃতকারীর খবরও কিছু আছে, তা ভেতরের পাতায়। নিতান্ত অবহেলায় এক কোণে ছাপা। তবু কি করে জানি এই সব খবরের দিকেই চোখ চলে যায়। অনিল চা খেতে খেতে কাগজ পড়ছে।
প্রথম পাতার খবর হল হাজির হওয়ার নির্দেশ। চোখে কালো চশমা, বগলে ব্যাটিনসহ টিক্কা খানের হাসি হাসি মুখের এক ছবির নিচে লেখা-খ অঞ্চলের সামরিক আইন প্রশাসক কর্নেল ওসমানীকে হাজির হওয়ার নির্দেশ প্ৰদান করেন। সরকারি নির্দেশে বলা হয়–
৪০ নম্বর সামরিক আইন বিধি অনুযায়ী প্রাপ্ত ক্ষমতাবলে আমি খ অঞ্চলের সামরিক আইন প্রশাসক লে. জে. টিক্কা খান এম. পি. কে. পি এসসি- আপনি কর্নেল এম. এ. জি. ওসমানীকে (অবসরপ্রাপ্ত) আপনার বিরুদ্ধে পাকিস্তান দণ্ডবিধির ১২১, ১২৩, ১৩১ ও ১৩২ নম্বর ধারা এবং ১০ ও ১৪ নম্বর সামরিক আইনবিধি অনুযায়ী আনীত অভিযোগের জবাব দেয়ার জন্যে ১৯৭১ সালের ২০ শে আগস্ট সকাল আটটার সময় ঢাকার দ্বিতীয় রাজধানীস্থ ১ নম্বর সেক্টরের উপসামরিক আইন প্ৰশাসকের সামনে হাজির হাজির হতে আদেশ দিচ্ছি।
যদি আপনি হাজিরে ব্যর্থ হন তাহলে আপনার অনুপস্থিতিতেই ৪০ নম্বর সামরিক আইন বিধি অনুযায়ী আপনার বিচার হবে।
বাণিজ্য, শিল্প ও আইন মন্ত্রী আখতার উদ্দিন আহমেদ সাহেবেরও একটি ছবি ছাপা হয়েছে টিক্কা খানের ছবির নিচে। মন্ত্রী জনসভায় বলেছেন
আল্লাহ না করুক, পাকিস্তান যদি ধ্বংস হয়ে যায় তাহলে মুসলমানরা তাদের আলাদা বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলবে এবং হিন্দুদের দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে পড়বে।
বক্স করে ছাপা হয়েছে- সাবধান, গুজব ছড়াবেন না। আপনার গুজব শক্ৰকেই সাহায্য করে।
দু পৃষ্ঠার খবরের কাগজ এইটুকুতেই শেষ। শেষের পাতায় সামরিক নির্দেশাবলি যা কিছুদিন পর পর ছাপা হচ্ছে। ভেতরের দুপাতার সবটাই বিজ্ঞাপন। এক কোণায় ছোট করে একটা সংবাদ- শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে অস্ত্রশস্ত্ৰ উদ্ধার : কয়েকজন গ্রেপ্তার।
গত রোববার রাতে ঢাকা শহরের বিভিন্ন অংশে কয়েকটি সফল অভিযান চালিয়ে বেশ উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অন্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ ও বিস্ফোরক উদ্ধার করা হয়েছে। এ ব্যাপারে কয়েক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। দেশপ্রেমিক নাগরিকদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এই অভিযানগুলো চালানো হয়।
গ্রেফতার করা দুটি ছেলের ছবি ছাপা হয়েছে। ছেলে দুটির বয়স কিছুতেই আঠারো উনিশের বেশি হবে না। দুজনেরই হাত পেছন দিকে বাধা। কিন্তু এদের মুখ হাসি হাসি। ছবি তোলার সময় এরা কি সত্যি হাসছিল না। অনিল কল্পনা করছে, এরা হাসছে? এদের নাম দেয় নি, নাম দেয়া উচিত ছিল।
ভাইজান, খবরের কাগজটা দেখি।
অনিল তার সামনে বসা মানুষটির দিকে কাগজ এগিয়ে দিল। সেও সব খবর ফেলে এই খবরটিই পড়ছে। একটা খবর পড়তে এতক্ষণ লাগে না। নিশ্চয়ই বার বার পড়ছে। মানুষটার চোখে-মুখে আনন্দের আভা। পত্রিকা বন্ধ করার পরেও সে আরেকবার খুলল, তাকিয়ে আছে। ছবিটার দিকে। অনিল বলল, কাগজটা আপনি রেখে দেন।