তারা বাড়ি পৌঁছল সন্ধ্যা মিলিয়ে যাবার পর। সুরেশ বাগচী বাড়ি পৌঁছে শুনলেন তাঁর মেয়ে সারাদিন কিছু খায় নি। দরজা বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে আছে। সুরেশ বাগচী উদাস গলায় বললেন, ভুল হয়ে গেছে রে মা। তোকে সঙ্গে নেয়া উচিত ছিল। আমরাও কিছু দেখতে পারি নি। আবার যেতে হবে। তখন নিয়ে যাব। গায়ে হাত দিয়ে বলছি রে মা।
অতসী ফুপাতে ফুপাতে বলল, ভেজা হাত সরাও তো বাবা। নিজেরা সব ভালো ভালো জিনিস দেখবে।
ভুল হয়ে গেছে রে মা। বিরাট ভুল হয়ে গেছে। তবে আমরা ভালো জিনিস কিছু দেখতেও পাই নি। বিশ্বাস করা। এবার থেকে ভালো জিনিস যা দেখব, তোকে নিয়ে দেখব।
অনিল কাঁঠাল গাছের মাথার মুকুটের দিকে তাকিয়ে মন ঠিক করে ফেলল। দেশটা ঠিকঠাক হলে এই দেশে যা কিছু সুন্দর জিনিস আছে সে তার বাবাকে আর অতসীদিকে নিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখবে। প্রথম ছয়মাস শুধু ঘুরে বেড়াবে। কোন একটু সুন্দর জিনিসের সামনে বাবাকে দাঁড় করিয়ে দিয়ে সে বলবে— বাবা দেখ তো, এর ছবি আঁকা যাবে কি-না। বাবা মাথা নাড়তে নাড়তে বলবেন, অসম্ভব। অতসীদি খিলখিল করে হাসবে। বাবা বিরক্ত হয়ে বলবেন, হাসছিস কেন মা? সৌন্দর্যের একটা অংশ থাকে, কখনো যার ছবি আঁকা যায় না। এই জিনিসটা বুঝতে হবে…
গফুর সাহেবের ঘর থেকে কোরান তেলাওয়াতের সুর ভেসে আসছে। তিনি উঠেন। অন্ধকার থাকতে থাকতে। নামায পড়েন। নামায্যের পরে অনেকক্ষণ কোরান তেলাওয়াত করেন। তার গলার স্বর মিষ্টি। পড়েনও খুব সুন্দর করে। প্রায়ই ভোরে অনিল বারান্দায় দাঁড়িয়ে শুনে। তার ভালো লাগে। শুধু ভালো লাগে বললে কম হয়, বেশ ভালো লাগে।
গফুর সাহেব দরজা খুলে অনিলকে দেখলেন। ক্লান্ত গলায় বললেন, রাতে ঘুম হয়েছিল অনিল?
জ্বি।
আমার এক ফোটা ঘুম হয় নি। সারারাত জেগে কাটালাম। খুব খারাপ লাগছে। গত রাতেও ঘুমাতে পারি নি। এভাবে দিন কাটালে তো বাঁচব না। কিছু একটা করা উচিত?
কি করবেন?
তাই তো জানি না। করব কি?
গফুর সাহেব কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে নিচু গলায় বললেন, তোমার একটা খবর আছে অনিল। কাল বিকেলে একটা ছেলে তোমার খোজে এসেছিল। অনেকক্ষণ তোমার জন্যে অপেক্ষা করে আমাকে চিঠি দিয়ে গেছে। খুবই দুঃসংবাদ। তোমাকে দুঃসংবাদটা কীভাবে দেব বুঝতে পারছিলাম না। রাতে এই জন্যেই ঘুম হয় নি। সারারাত চিন্তা করেছি। এখন মনে হচ্ছে দুঃসংবাদটা দেয়া উচিত। সব মানুষেরই দুঃসংবাদ জানার অধিকার আছে। মন শক্ত কর অনিল।
অনিল তাকিয়ে আছে। গফুর সাহেব তার কাঁধে হাত রেখে প্ৰায় অস্পষ্ট গলায় বললেন, তোমার বাবা মারা গেছেন। অনিল। এটা সহজভাবে নেয়ার চেষ্টা কর। আরো অসংখ্য মৃত্যু ঘটবে। এগুলো নিয়ে আমরা এখন কোন কান্নাকাটি করব না। দেশ স্বাধীন হোক। দেশ স্বাধীন হবার পর আমরা চিৎকার করে কাঁদব। নাও চিঠিটা পড়া।
অনিল চিঠি পড়ল। তার চোখ শুকনো। মুখ ভাবলেশহীন। অনিলের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে গফুর সাহেবের চোখে পানি এসে গেছে। তিনি পাঞ্জাবির প্রান্ত দিয়ে চোখ মুছছেন। অনিল ছেলেটিকে তিনি খুবই পছন্দ করেন। ভদ্র, লাজুক এবং অতি বিনয়ী ছেলে। কোরান পাঠের পর বারান্দায় এলে রোজই এই ছেলেকে দেখেন। একদিন সে লাজুক গলায় বলল, আমি চিঠি পেয়েছি আমার বাবা খুব অসুস্থ। নতুন চাকরি, এরা ছুটি দিচ্ছে না। যেতে পারছি না। আপনি কি আমার বাবা জন্যে একটু প্রার্থনা করবেন?
গফুর সাহেব বললেন, অবশ্যই করব, অবশ্যই। আমি খাস দিলে উনার জন্য দোয়া করব। আলাদা নফল নামায পড়ব। তুমি মোটেও চিন্তা করবে না। দেখি আসি, আসা আমার ঘরে, চা খাও। অনিল তার ঘরে এসে কেঁদে ফেলল।
সেই ছেলে বাবার মৃত্যুসংবাদের চিঠি হাতে নিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। চিঠিটা সে দ্বিতীয়বার পড়ে নি। তার চোখ শুকনো। সে তাকিয়ে আছে কাঁঠাল গাছটার দিকে। কে জানে ছেলেটার মনের ভেতর এখন কি হচ্ছে।
গফুর সাহেব নিজের ঘরে ঢুকে গেলেন। আজকের মতো কোরান পাঠ তিনি শেষ করেছিলেন। এখন আরো খানিকটা পড়তে ইচ্ছা করছে।
আলিফ লাম মীম। জালিকাল কিতাবু লা রাইবা ফীহা, হুদাল্লিল মুত্তাকীন।
ইহা সেই গ্ৰন্থ যাহাতে কোনই সন্দেহ নাই। যাহা বিশ্বাসীদের পথ প্ৰদৰ্শক।
অনিল ঘরে ঢুকল। জানালা খুলে দিল। অন্ধকার ঘর ক্রমে আলো হয়ে উঠছে। আকাশ পরিষ্কার। ঝকঝকে নীল। বাতাস মধুর। শ্রাবণ মাসের অপূর্ব সুন্দর একটা সকাল।
অনিল কাপড় পরছে। সে রূপেশ্বর রওনা হবে। তার এখন কেন জানি মোটেই ভয় লাগছে না। চুল আঁচড়াবার জন্য চিরুণি খুঁজতে ড্রয়ারে টান দিতেই একগাদা চিঠি বেরিয়ে পড়ল। দুএকটা পড়েছে মেঝেতে। অনিলের কাছে লেখা তার বাবা এবং অতসীদির চিঠি। তার কাছে লেখা তার বাবার শেষ চিঠিটিই সে শুধু সঙ্গে নিয়ে যাবে। বাকিগুলো থাকুক। যেমন আছে শেষ চিঠিতে সুরেশ বাগচী লিখেছেন–
বাবা অনিল,
অত্যন্ত বিষণ্ণ মনে তোমাকে পত্র দিতেছি। চারিদিকের আবহাওয়া আমার ভালো বোধ হইতেছে না। শংকিত বোধ করিতেছি। মন বলিতেছে এই দেশ বড় ধনের কোন বিপর্যয়ের ভিতর দিয়া যাইবে। নিজের জন্যে এবং অতসীর জন্যে আমার কোন চিন্তা নাই। তোমাকে নিয়াই যত ভয়। রাজধানীতে আছ। বিপর্যয়ের প্রথম ধাক্কাটা তোমাদের উপর দিয়াই যাইবে। তুমি ভীতু ধরনের ছেলে, কি করিতে কি করিবে তাহাই আমার চিন্তা। বিপদে মাথা ঠাণ্ডা। রাখিও এবং ঈশ্বরকে স্মরণ রাখিও। তুলিও না- মঙ্গলময় ঈশ্বর তাহার বিরাট জগতের প্রতিটি জীবের কথা ভাবেন। আমাদেরও উচিত তাহার কথা ভাবা।