গফুর সাহেব ভেবেছিলেন রাতে চিঠিটা দেবেন। এখন অনিলের দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছে চিঠি না দেয়াই ভালো। ছেলেটা ভয়ে অস্থির হয়ে আছে। এই খবর পেলে কি করবে। কে জানে।
অনিল।
জ্বি।
আসি আমার ঘরে আস, চা খাও।
অনিল উঠে এল। গফুর সাহেব কেরোসিনের চুলায় কেতলি বসিয়ে দিলেন। দুজন মেঝেতে মুখোমুখি বসে আছে। কারো মুখেই কোন কথা নেই। অস্বস্তি কাটাবার জন্যে গফুর সাহেব বললেন, আজকের পূর্বদেশটা পড়েছ?
অনিল বলল, না। আমি এখন খবরের কাগজ পড়ি না। পড়তে ইচ্ছা করে না।
আমারো পড়তে ইচ্ছা করে না। অভ্যাসের বসে পড়ি। তবে আজকের পূৰ্বদেশটা তোমার পড়া উচিত। নাও, এই জায়গাটা পড়। মন দিয়ে পড়।
অনিল পড়ল।
পাকিস্তানের আজাদী দিবস উপলক্ষে গোলাম আযমের আহবান। আযাদী দিবস উপলক্ষে কেন্দ্রীয় শান্তিকমিটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কার্জন এক বিশাল সভার আয়োজন করে। সেই সভায় জনাব আযম পাকিস্তানের দুশমনদের মহল্লায় মহল্লায়। তন্ন তন্ন করে খুঁজে তাদের অস্তিত্ব বিলোপ করার জন্য দেশপ্রেমিক নাগরিকদের শান্তি কমিটির সঙ্গে সহযোগিতা করার জন্য উদাত্ত আহবান জানান।
পড়েছ অনিল?
জি।
তোমার খুব সাবধানে থাকা দরকার। মেসে থাকাটা একেবারেই উচিত না। মিলিটারীর তিনটা টার্গেট— আওয়ামী লীগ, হিন্দু, যুবক ছেলে। তারপর আবার শুনলাম মেসে কারা কারা তাদের নাম-ধাম পরিচয় জানতে চেয়ে চিঠি এসেছে। কামাল মিয়া বলল।
কে চিঠি দিয়েছে?
স্থানীয় শান্তি রক্ষা কমিটির এক লোক- এস এম সোলায়মান। মজার ব্যাপার কি জান— আগে এই লোক ঘোর আওয়ামী লীগারে ছিল। শেখ সাহেবের ভাষণ ক্যাসেট করে নিয়ে এসেছিল। মাইক বাজিয়ে মহল্লায় শুনিয়েছে। এখন সে বিরাট পাকিস্তানপন্থি। মানুষের চরিত্র বোঝা খুব কঠিন। তবে আমি তাকে ঠিক দোষও দিচ্ছি না। সে হয়ত যা করছে প্ৰাণ বাচানোর জন্যে করছে। এসব না করলে আওয়ামী লীগার হিসেবে তাকে মেরে ফেলত। ঠিক না?
অনিল কিছু বলল না। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে নিঃশব্দে চুমুক দিতে লাগল। চা-টা খেতে ভালো লাগছে। বেশ ভালো লাগছে।
চায়ের সঙ্গে আর কিছু খাবে? চানাচুর আছে। দেব চানাচুর? টেনশনের সময় খুব ক্ষিধা পায়।
অনিল বলল, আমি আর কিছু খাব না। চা থাকলে আরেকটু নেব।
গফুর সাহেব। আবার কাপ। ভর্তি করে দিলেন। নিচু গলায় বললেন, তুমি বরং মেসটা ছেড়ে দাও।
মেস ছেড়ে যাব কোথায়? ঢাকা শহরে আমার পরিচিত কেউ নেই। ফতুল্লায় এক মামা থাকতেন। এখন আছেন কি-না তাও জানি না।
গফুর সাহেব হঠাৎ অপ্রাসঙ্গিকভাবেই জিজ্ঞেস করলেন, তোমার বাবার শেষ চিঠি কবে পেয়েছ?
কেন জিজ্ঞেস করছেন?
এম্নি জানতে চাচ্ছি। কোন কারণ নেই।
বাবার শেষ চিঠি পেয়েছি। চার মাস আগে। এখন কেমন আছেন কিছুই জানি না। আমি বেশ কয়েকটা চিঠি দিয়েছি। জবাব পাচ্ছি না।
গফুর সাহেব বলরেন, যাও শুয়ে পড়। রাত অনেক হয়েছে।
অনিল নিজের ঘরে চলে এল। বাতি নিভিয়ে বিছানায় যাওয়ামাত্র বৃষ্টি শুরু হল। ঝুম বৃষ্টি।
জানালা খুলে একটু বৃষ্টি দেখলে কেমন হয়? কত দিন জানালা খুলে ঘুমানো হয় না। আহা কেমন না জানি লাগে জানালা খোলা রেখে ঘুমুতে। দেশ স্বাধীন যদি সত্যি সত্যি হয় তাহলে সে কয়েক রাত রাস্তার পাশে পাটি পেতে ঘুমুবে। সে রাতগুলোতে ঘুম আসবে না। সে রাতগুলো কাটাবে রাস্তায় হেঁটে হেঁটে।
ভাল বৃষ্টি হচ্ছে তো। ঝড় বৃষ্টির সময় মিলিটারীরা রাস্তায় থাকে না। এরা বৃষ্টি ভয় করে। হোক বৃষ্টি। দেশ ভাসিয়ে নিয়ে যাক। পদ্মা-মেঘনা-যমুনায় বান ডাকুক। শো শো শব্দে ছুটে আসুক জলরাশি।
টকটক শব্দে টিকটিকি ডাকছে। এই ঘরে চারটা টিকটিকি আছে। একটার গা ধবল। কুষ্ঠের রুগীর মতো সাদা। একটা মাকড়সা আছে। সে সম্ভবত আয়নার পেছনে থাকে। ঠিক রাত আটটায় পেছন থেকে এসে আয়নার উপর বসে থাকে। এমন নিখুঁত সময়ে ব্যাপারটা ঘটে যে মনে হয় মাকড়সাটার নিজের কাছেও কোন ঘড়ি আছে। সম্ভবত টিকটিকিগুলো তাকে খেয়ে ফেলেছে। সারভাইভাল অব দি ফিটেষ্ট। যে ফিট সে টিকে থাকবে।
বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। নীল আলোয় ঘর ভেসে গিয়ে আবার সব অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। অল্প বৃষ্টি হলেই মেসের সামনের রাস্তাটায় এক হাঁটু পানি হয়। সারারাত বৃষ্টি হোক, রাস্তায় এক কোমর পানি জমে যাক। পানি ভেঙে মিলিটারী জীপ আসবে না। ওরা শুকনো দেশের মানুষ। পানিতে ওদের খুব ভয়।
ঝড় হচ্ছে না-কি? জানালায় শব্দ হচ্ছে। কাকটা তারস্বরে চেচাচ্ছে। সাধারণত একটা কাক ডাকলে দশটা কাক এসে উপস্থিত হয়। কিন্তু এই কাকটা নিঃসঙ্গ, বন্ধুহীন। এর ডাকে কখনো কাউকে সাড়া দিতে অনিল শুনে নি। সে থাকেও একা একা। তার পুরুষ বন্ধুও তাকে ছেড়ে গেছে। সে কি দরজা খুলে কাকটাকে ভেতরে আসতে বলবো?
ঘুমে অনিলের চোখ জড়িয়ে আসছে। সারাদিন অসহ্য গরম ছিল। এখন পৃথিবী শীতল হয়েছে। বৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে ভয় কেটে যাচ্ছে। বার বার মনে হচ্ছে- এমন দুর্যোগে মিলিটারী পথে নামবে না। অন্তত আজকের রাতটা মানুষের শান্তিতে কাটবে। অনিল ঘুমিয়ে পড়ল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে চমৎকার স্বপ্ন দেখল। অনিল যেন খুব ছোট। তারা নৌকায় করে মামার বাড়ি যাচ্ছে। রূপবতী একজন তরুণীর কোলে সে বসে আছে। তার খুব লজ্জা লাগছে। অনিলের বাবা বললেন, ছেলে দেখি লজ্জায় মারা যাচ্ছে। আরো বোকা, এটা তোর মা। মার কোলে বসায় আবার লজ্জা কি? রূপবতী তরুণীটি বলছে- আহা ও কি আমাকে চিনে। লজা তো পাবেই। এটাই তো স্বাভাবিক। রূপবতী তরুণীর মুখ তখন খানিকটা মোক্তার পাগলির মতো হয়ে গেল। এবং সে বলতে লাগল— চিরণিটা কই? দেখি অতসী চিরণিটা দে তো। আমি বাবুর চুল আঁচড়ে দেই। অতসী খিলখিল করে হাসতে হাসতে বলল, ওকে বাবু ডাকছ কেন? ওর নাম আনিল। তখন কোথেকে যেন কাক ডাকতে লাগল- কা-কা-কা।
কা-কা-কা-কা
কা-কা-কা-কা। আসলেই কাক ডাকছে।