একদিন অনিল ধরা পড়ে গেল মোক্তার পাগলির হাতে। তখন ক্লাস সেভেনে পড়ে। হাফইয়ার্লি পরীক্ষা শেষ করে বাড়ি ফিরছে। পোস্টাপিসের কাছে আসামাত্র মোক্তার পাগলি ছুটে এসে অনিলকে হাত চেপে ধরল। মেলায় যেমন হয়েছিল অনিলের সে রকম হল। মনে হল সে কিছু দেখতে পারছে না। তার হৃৎপিণ্ড লাফাচ্ছে। এক্ষুণি বোধহয় হৃৎপিণ্ড ফেটে চৌচির হয়ে যাবে। নাক দিয়ে সে নিঃশ্বাস নিতে পারছে না। হা করে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। চারদিকে লোক জমে গেছে। সবাই মজা দেখছে। বড়ই মজাদার দৃশ্য।
মোক্তার পাগলি এক ঝটিকায় অনিলকে কোলে তুলে ফেলল। তার অনাবৃত স্তনে অনিলের মুখ চেপে বলল, খা দুধ খা। খা। কইলাম।
দর্শকরা বিপুল আনন্দে হেসে ফেলল। অনিলের নাম হয়ে গেল দুদু খাওয়া অনিল। দুটি অনিল ছিল ক্লাসে। একজন শুধু অনিল, অন্যজন দুদু খাওয়া অনিল।
অনিল ক্লাসে যাওয়া ছেড়ে দিল। স্কুলের সময় দরজা বন্ধ করে বসে থাকত। চেচিয়ে কাঁদত। অতসী বাবাকে গিয়ে বলত, থাক বাবা, আজ স্কুলে না গেল।
একদিন সুরেশ বাগচী ছেলেকে ডেকে বললেন, তোকে দুধ খাইয়েছে তো কি হয়েছে? মাতৃস্নেহে দুগ্ধপান করানোর চেষ্টায় দােষের কিছু না। মাতৃভাবে তাকে সম্মান করবি, তাহলেই হবে। আয় তোর ভয় ভাঙিয়ে দিয়ে আসি।
অনিল বলল, না।
না বলবি না। না বলা দুর্বল মানুষের লক্ষণ। আয় আমার সাথে। অতসী তোর মার একটা শাড়ি বের করে দে।
অতসী বলল, শাড়ি কি করবে?
মোক্তার পাগলিকে দেব। নগ্ন ঘুরে বেড়ায় দেখতে খারাপ লাগে।
মার শাড়ি কাউকে দিতে দিব না বাবা।
নতুন শাড়ি কেনার পয়সা নাইরে মা। দে, তোর মার একটা শাড়ি দে। মার স্মৃতি তো শাড়িতে থাকে না রে মা। মার স্মৃতি থাকে অন্তরে।
এক হাতে লাল পাড় শাড়ি নিয়ে অন্য হাতে শক্ত করে অনিলের হাত ধরে সুরেশ বাগচী নগ্ন পাগলিকে খুঁজে বের করলেন। পাগলি কঠিন চোখে তাকাল। সুরেশ বাগচী বললেন, আমার এই পুত্র আপনার ভয়ে অসম্ভব ভীত। আমি শুনেছি আপনি তাকে পুত্ৰস্নেহে দুগ্ধ পান করাবার চেষ্টা করেছেন। কাজেই সে আপনার পুত্ৰস্থানীয়। আপনি আপনার পুত্রের ভয় ভাঙিয়ে দিন।
পাগলি এইসব কঠিন কথার কি বুঝল কে জানে, তবে সে হাতে ইশারা করে অনিলকে কাছে ডাকল। অনিল ভয়াবহ আতঙ্কে বাবাকে জড়িয়ে ধরল। সুরের বাগচী বললেন, ছেলে আপনার জন্যে একটা শাড়ি এনেছে, তার মায়ের ব্যবহারী শাড়ি। আপনি গ্ৰহণ করলে আমরা খুশি হব।
পাগলি হাত বাড়িয়ে শাড়ি নিল।
সুরেশ বাগচী বললেন, পুত্রের কাছে নগ্ন অবস্থায় উপস্থিত হওয়া শোভন নয়। আপনি শাড়িটা পরে আমার ছেলের গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দিন।
পাগলি বলল, দূর হ হারামজাদা।
আমি হাতজোড় করে মিনতি করছি। আপনি তাকে আর ভয় দেখাবেন। না। মা-মরা ছেলে, সে জন্ম থেকেই ভীতু। আপনি তার মাতৃস্থানীয়। আপনার ভয়ে সে স্কুলে যাওয়া ছেড়ে দিয়েছে।
পাগলি নিজের গায়ে শাড়ি মেলে ধরতে ধরতে হাসি মুখে বলল, দূর হ, দূর হ কইলাম।
আশ্চর্যের ব্যাপার! পাগলি আর কোনদিনই অনিলকে ভয় দেখায় নি। লালপেড়ে শাড়ি তাকে কখনো পরতে দেখা যায় নি। সে নগ্ন হয়েই ঘুরত। অনিলকে দেখলে থমকে দাঁড়িয়ে লাজুক গলায় বলতো, এই পুলা, মাথার চুল আচড়াও না ক্যান? একটা চিরুণি আনবা, চুল আঁচড়াইয়া দিমু। অনিল দৌড়ে পালিয়ে যেত। তার ভয় কাটে নি। শরীরের সমস্ত স্নায়ু অবশ করে দেয়া তীব্র ভয়।
দরজার কড়া নড়ে উঠল।
অনিলের হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। কেউ একজন দরজার পাশে তাহলে দাড়িয়ে ছিল? কে সে? কে? অনিলের ঘাম হচ্ছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে।
অনিল ঘুমোচ্ছ?
গফুর সাহেবের গলা। তবু অনিল বলল, কে কে?
আমি। ভয়ের কিছু নাই। আমি। দরজা খোল।
অনিল বিছানা ছেড়ে উঠেছে। সুইচ বোর্ড খুঁজে পাচ্ছে না। সমস্ত দেয়াল হাতড়ে বেড়াচ্ছে সুইচ বোর্ডের জন্যে। তার বালিশের নিচে টর্চ লাইট। একবারও টর্চ লাইটের কথা তার মনে আসছে না। তাকে ডাকছেন। গফুর সাহেব। সর্ব দক্ষিণের সিঙ্গেল রুমে থাকেন। এজি অপিসের সিনিয়ার অ্যাসিসটেন্ট। এই বছরেই রিটায়ার করার কথা। ঢাকায় বাসা করে থাকতেন। স্ত্রী মারা যাবার পর বাসা ছেড়ে মেসে এসে উঠেছেন। একা মানুষ। বাসা ভাড়া করে এতগুলি টাকা নষ্ট করতে ইচ্ছে করে নি। প্রয়োজনও নেই। দুটি মেয়ে। দুজনেরই বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। একজন থাকে রাজশাহীতে, একজন খুলনায়। সুইচ বোর্ড খুঁজে পাওয়া গেল। অনিল বাতি জ্বালাল, দরজা খুলল। গফুর সাহেব বললেন, ঘুম আসছিল না, এ জন্যেই ডাকলাম। অন্য কিছু না।
এতক্ষণ ধরে আপনিই কি হাঁটাহাঁটি করছিলেন?
হুঁ। বৃষ্টি হবে বলে মনে হচ্ছে। আকাশে খুব মেঘ। তুমি কি চা খাবে অনিল? রাতে ঘুম ভালো হয় না। একটু পরে পরে চা খাই। খাবে?
না।
আস না, একটু চা খাও। সময় খারাপ। কথা-টথা বললে ভালো লাগে। গফুর সাহেব কথাগুলি বলার সময় একবারও অনিলের দিকে তাকালেন। না। অন্যদিকে তাকিয়ে কথা বললেন। কারণ তিনি অনিলের দিকে সরাসরি তাকাতে পারছেন না। আজ দুপুরে একটা ছেলে অনিলের একটা চিঠি দিয়ে গেছে তার হাতে। চিঠিটা অনিলকে পৌঁছানোর দায়িত্ব তাঁর। সেই খোলা চিঠি তিনি কয়েকবার পড়েছেন। ভয়ংকর দুঃসংবাদের এই চিঠি তিনি অনিলকে দেয়ার মতো মনের জোর সংগ্রহ করতে পারেন নি। রূপেশ্বর স্কুলের হেড মাস্টার মনোয়ার উদ্দিন খাঁ লিখেছেন
বাবা অনিল,
তোমাকে একটি দুঃখের সংবাদ জানাইতেছি। এপ্রিল মাসের নয় তারিখে রূপেশ্বরে পাক মিলিটারী উপস্থিত হয়। তাঁহাদের আকস্মিক আগমনের জন্যে আমরা কেহই প্ৰস্তৃত ছিলাম না। তাহারা রূপেশ্বরে অবস্থান নেয়। এপ্রিল মাসের বার তারিখে আরো অনেকের সঙ্গে তাহারা তোমার বাবাকে হত্যা করে। আমরা তাহাকে বাচানোর সর্বরকম চেষ্টা করিয়াছি। এর বেশি। আমি আর কি বলিব? তোমার ভগ্নিকে আমি আমার বাড়িতে আনিয়া রাখিয়াছি। তাহার বিষয়ে তুমি চিন্তা করিবে না। আল্লাহ পাকের নামে শপথ নিয়া বলিতেছি, আমার জীবন থাকিতে আমি অতসী মায়ের কোন অনিষ্ট হইতে দিব না। তোমার পিতার মৃত্যুতে রূপেশ্বরের প্রতিটি মানুষ চোখের জল ফেলিয়াছে। এই কথা তোমাকে জানাইলাম। জানি না ইহাতে তুমি মনে কোন শান্তি পাইবে কি-না। আল্লাহ পাক তাঁহার আত্মার শান্তি দিন, এই প্রার্থনা করি। তুমি সাবধানে থাকিবে। ভুলেও রূপেশ্বরে আসিবার কথা চিন্তা করিবে না। একদল মুক্তিযোদ্ধা রূপেশ্বর থানা আক্রমণ করিবার চেষ্টা করায় ভয়াবহ ফল হইয়াছে। রূপেশ্বরে বর্তমানে কোন যুবক ছেলে নাই।…