শুধুমাত্র একজন যাত্রীর জন্যে এটা কেন করা হল তা বোঝা যাচ্ছে না। সম্ভবত মজা করার জন্যেই। উঠ-বোসের পর্ব সুষ্ঠুভাবে অগ্রসর হচ্ছে। যাকে উঠ-বোস করতে বলা হয়েছে, সে এই কাজটি বেশ আগ্রহ নিয়ে করছে বলে মনে হল।
ক্যাপ্টেন সাহেব তেমন আগ্রহ বোধ করছেন না। তার চোখ বিষণ্ণ।
অনিল এবং আয়ুব আলি লাইনের শেষ মাথায়। সুবাদার সাহেব অনিলের পাশে এসে দাঁড়াল। বাঙালি দোভাষীর চা খাওয়া শেষ হয়েছে। সে এসে সুবাদারের কাছে দাঁড়াল।
কি নাম?
অনিল। অনিল বাগচী।
হতভম্ব আয়ুব আলি বললেন, ঠিক নাম বলেন। ঠিক নামটা স্যারকে বলেন। স্যার ইনার আসল নাম মোহাম্মদ সাহসিন। বাপ মা আদর করে অনিল ডাকে।
তোমার নাম মোহাম্মদ মহসিন?
অনিল চুপ করে রইল। আয়ুব আলি বড়বড় করে বললেন, আমার খুবই পরিচিত স্যার। দূর সম্পর্কের রিলেটিভ হয়। খাঁটি মুসলমান।
বাঙালি দোভাষী বলল, অনিল হইল হিন্দু নাম।
আয়ুব আলি হাসি মুখে বললেন, একুশে ফেব্রুয়ারির জন্যে এটা হয়েছে ভাইসাহেব। বাপ মারা আদর করে ছেলেমেয়েদের বাংলা নাম রাখে। যেমন ধরেন- সাগর, পলাশ। ছেলেপুলের তো কোন দোষ নাই, বাপ মায়ের দোষ।
বাঙালি দোভাষী এবার যথেষ্ট আগ্ৰহ বোধ করছে বলে মনে হল। সে ক্যাপ্টেনের দিকে তাকিয়ে বলল, এই দুইটাই হিন্দু। মিথ্যা কথা বলতেছে।
অনিল বলল, ইয়েস স্যার।
তুমি মুক্তিবাহিনীর লোক?
না স্যার।
আওয়ামী লীগ?
না।
মুজিবের পা-চাটা কুকুর। মুজিবের পা কখনো চেটে দেখেছ? কেমন লাগে পা চাটতে?
অনিল চুপ করে রইল। ক্যাপ্টেন বললেন, একে ঘরে নিয়ে যাও।
আয়ুব আলি ব্যাকুল গলায় বললেন, স্যার আমার একটা কথা শুনেন স্যার। যে কেউ একবার কলেমা পড়লেও মুসলমান হয়ে যায়। এটা হাদিসের কথা। মহসিন কলেমা জানে। তারে জিজ্ঞেস করেন। সে বলবে।
ক্যাপ্টেম আয়ুব আলির দিকে তাকিয়ে কড়া গলায় বললেন, তুমি নিজে মুসলমান?
জ্বি জনাব, মুসলমান। সুন্নি মুসলমান। আমরা পীর বংশ। আমার দাদা মরহুম মেরাজ উদ্দিন সরকার পীর ছিলেন।
বাঙালি দোভাষী বলল, এই হারামীও হিন্দু। বিরাট ধড়িবাজ।
আয়ুব আলির চোখ শক্ত হয়ে গেল। তিনি ঘাড় ফিরিয়ে বাসের দিকে তাকালেন। বাস থেকে এখানকার কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে না। তবে বাসের প্রতিটি মানুষ ভীত চোখে এই দিকেই তাকিয়ে আছে। আয়ুব আলি সাহেবের স্ত্রী এবং বড় মেয়েটি কাঁদতে শুরু করেছে। সবচে ছোট মেয়েটি জানালায় হাত বাড়িয়ে ভীত গলায় বলছে- আকবু আসি, আরু আস।
বাঙালি দোভাষী আয়ুব আলির দিকে তাকিয়ে বলল, প্যান্ট খোল। প্যান্ট খুলে দেখা খৎনা হয়েছে কিনা। স্যারকে দেখা।
আয়ুব আলি কঠিন গলায় বললেন, প্যান্ট যদি খুলতে হয় তাহলে আমি তোর মুখে পিসাব করে দেব। আল্লার কসম আমি পিসাব করব।
অনেকক্ষণ পর ক্যাপ্টেন মনে হয় কিছুটা মজা পেলেন। তিনি শব্দ করে হেসে ফেললেন। ক্যাপ্টেনের সঙ্গে অন্যরাও হেসে ফেলল। শুধু বাঙালি দোভাষী হাসল না। সে অন্যদের হাসির কারণও ঠিক ধরতে পারছে না। সে বিরক্ত ও ক্রুদ্ধ। ক্যাপ্টেন আয়ুব আলির দিকে তাকিয়ে বললেন, যাও, গাড়িতে গিয়ে উঠ।
আয়ুব আলি বললেন, স্যার মহসিন সাহেবকে নিয়ে যাই?
ও থাকুক। তোমাকে উঠতে বলেছি, তুমি উঠ।
আয়ুব আলি ব্যথিত চোখে অনিলের দিকে তাকালেন। অনিল শান্ত গলায় বলল, আমার বড় বোন আছেন রূপেশ্বর হাই স্কুলের হেডমাস্টার সাহেবের বাড়িতে…
আয়ুব আলি অনিলের কথা শেষ করতে দিলেন না। ছেলে মানুষের মতো ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললেন কসম খেয়ে বলতেছি, আপনার যদি কিছু হয় আমি আপনার বোনকে দেখব, যতদিন বাঁচব দেখব। বিশ্বাস করেন আমার কথা। বিশ্বাস করেন।
আমি আপনার কথা বিশ্বাস করছি। আপনি আমার বোনকে বলবেন, আমি ভয় পাই নাই। আর তাকে বলবেন আমি বলে দিয়েছি- সে যেন তার পছন্দের ছেলেটাকে বিয়ে করে। কে কি বলে এটা নিয়ে সে যেন চিন্তা না করে।
আয়ুব আলি গাড়িতে উঠলেন। তাঁর স্ত্রী এবং ছেলেমেয়েদের কান্না আরো বেড়ে গেল। বড় মেয়েটি বাবাকে জড়িয়ে ধরে আছে। সে থর থর করে কাঁপছে।
বাস ছেড়ে যাবার আগ-মুহুর্তে ক্যাপ্টেন সুবাদারের দিকে তাকিয়ে বললেন, সুট পরা লোকটাকে রেখে দাও। ঐটাও বদমাশ। ওর কিছু একটা মতলব আছে- টের পাওয়া যাচ্ছে না।
আবু হোসেন তার সমস্ত শক্তি দিয়ে বাসের হ্যান্ডেল ধরে আছে। কিছুতেই তাকে টেনে নামানো যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে তার গায়ে অসুরের শক্তি। জীবন থাকতে সে বাসের হ্যান্ডেল ছাড়বে না। আবু হোসেন হাঁপাতে হাঁপাতে বলছে— ভাইসাহেব, আপনারা আমাকে বাঁচান। ভাইসাব, আপনারা সবে মিলে আমাকে বাঁচানোর চেষ্টা করেন।
আবু হোসেনকে নামানো হয়েছে। সে হাত পা ছড়িয়ে রাস্তার পাশে পড়ে আছে। বাস ছেড়ে দিয়েছে। ক্যাপ্টেন হাই তুললেন। সুবাদারকে বলল, এই দুজনকে নদীর পাড়ে নিয়ে যাও।
এখন নিব?
না রাতে। রাতই ভালো।
ক্যাপ্টেন আবার হাই তুললেন। তার ঘুম পাচ্ছে।
খুব জ্যোৎস্না হল সে রাতে
খুব জ্যোৎস্না হল সে রাতে। উথাল-পাথাল জ্যোৎস্নার ভেতর তারা অনিলকে হাঁটিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আবু হোসেনকে নেয়া হচ্ছে না। কারণ তাকে নেয়ার প্রয়োজন নেই। মুগ্ধ হয়ে জ্যোৎস্না দেখতে দেখতে অনিল যাচ্ছে। দোভাষী বাঙালি যাচ্ছে তার পাশে পাশে। অনিল তাকে বলল, কি সুন্দর জ্যোৎস্না হয়েছে দেখেছেন? এই সৌন্দর্যের ছবি আঁকা সম্ভব নয়। সৌন্দর্যের একটি অংশ আছে যার ছবি আঁকা যায় না।