অনিল চোখ মুছতে মুছতে বল, পেইন।
এই তো হয়েছে। আচ্ছা বাবা, এখন পেইন বানান করতো। কোন কিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকলে ব্যথা কম লাগবে। বানান করতো পেইন। আচ্ছা, আমি তোমাকে সাহায্য করছি। প্ৰথম অক্ষর হল পি।
সুরেশ বাগচীর প্রাণপণ চেষ্টাতেও অনিলের ইংরেজি বিদ্যা বেশিদূর অগ্রসর হয় নি। ইংরেজিতে আই. এ. পরীক্ষায় রেফার্ড পেয়ে গেল। সুরেশ বাগচী মনের দুঃখে পুরো দিন না খেয়ে রইলেন এবং সন্ধ্যাবেলা দরজা বন্ধ করে ছোট ছেলেমেয়েদের মতো শব্দ করে কাঁদতে লাগলেন। অনিল শুকনো মুখে বারান্দায় বসে রইল। অনিলের বড় বোন অতসী বাবার ঘরের দরজায় ধাক্কা দিতে দিতে বলতে লাগল, দরজা খোল বাবা। দরজা খোল। সুরেশ বাগচী বললেন, এই কুলাঙ্গারকে বেরিয়ে যেতে বল অতসী। কুলাঙ্গারের মুখ দেখতে চাই না। অনিল ঘর থেকে বের হয়ে একা এক রূপেশ্বর নদীর ঘাটে বসে রইল।
অন্ধকার রাত। জনমানব শূন্য নদীর ঘাট। ওপারে শ্মশান, মড়া পুড়ানো হয়। কয়দিন আগেই মড়া পুড়িয়ে গেছে। ভাঙা কলসী, পোড়া কাঠ আবছা করে হলেও নজরে পড়ে। অনিলের গা ছমছম করতে লাগল। মনে হতে লাগল অশরীরী মানুষজন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকে দেখছে। নিঃশব্দে চলাফেরা করছে তাকে ঘিরে। এই তো কে যেন হাসল। শিয়াল ডাকছে। শিয়ালের ডাক এমন ভয়ংকর লাগছে কেন? অনিল ভয়ে কাপতে লাগল। সে যে দৌড়ে বাড়ি চলে যাবে সেই সাহসও রইল না।
গভীর রাতে হারিকেন হাতে সুরেশ বাগচী ছেলেকে খুঁজতে এলেন। নদীর পাড়ে এসে কোমল গলায় বললেন, অনিল বাবা, আয় বাড়ি যাই। তিনি হাত ধরে ছেলেকে নিয়ে এগুতে লাগলেন। এক সময় বিস্মিত হয়ে বললেন, এমন কাপছিস কেন?
ভয় লাগছে। বাবা।
আরো বোকা, কিসের ভয়? শেকসপিয়ার কি বলেছিলেন, কাউয়ার্ডস ডাই মেনি টাইমস বিফোর দেয়ার ডেথ। ভীতুদের মরবার আগেও অনেকবার মরতে হয়। বলতো শেকসপিয়ারের কোন বইয়ে এই লেখাটা আছে। তোকে আগে একবার বলেছি। কি, পারবি না?
ছেলেবেলার অন্ধ, তীব্র ভয় আবার ফিরে এসেছে। অনিল এখন ঘুমুতে পারে না। রাত জেগে জেগে নানান ধরনের শব্দ শুনে। আতংকে কোপে কেপে উঠে। সবচে বেশি ভয় পায় যখন কাক ডেকে উঠে। আচমকা এই কাকটা কাকা করে আত্মা কাঁপিয়ে দেয়।
পরিষ্কার চটি পায়ে হাঁটার শব্দ। কে হাঁটছে চটি পায়ে? রহিম সাহেব? রহিম সাহেবের মাঝে মাঝে গভীর রাতে হাঁটার অভ্যাস আছে। তাঁর তো আজ সকালে চলে যাবার কথা ছিল। যেতে পারেন নি? অনিল বলল, কে? কে হাঁটে?
কেউ জবাব দিল না। হুস করে একটা ট্রাক চলে গেল। কুকুর ডাকছে। ঢাকা শহরের কুকুরগুলি এখন খুব ডাকছে। মিলিটারী না-কি অনেক কুকুর মেরেছে। রাত দুপুরে কুকুরগুলি আচমকা ডেকে উঠছে- মিলিটারীরা ভয় পেয়ে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়ে। কুকুর এখন মিলিটারী চিনে ফেলেছে। হঠাৎ কোন রাস্তা কুকুরশুন্য হলে বুঝতে হবে মিলিটারী সেখানে আছে। কিংবা তারা আসছে। বাঘের আগে ফেউ ডাকার মতো, মিলিটারীর আগে কুকুর ডাকে।
পায়ের শব্দটা আবার আসছে। ঠিক তার দরজার কাছে এসে শব্দ থেমে গেল। অনিল ক্ষীণ স্বরে বলল, কে? তার নিজের গলার শব্দ সে নিজেই শুনতে পেল না। তাকে ধরার জন্যে কি মিলিটারী চলে এসেছে? একটু আগে যে ট্রাকের শব্দ শোনা গেল, সেই ট্রাকে করেই কি তাকে অজানা কোন জায়গায় নিয়ে যাওয়া হবে? সে দরজা খুলবে। আর তাকে নিয়ে ট্রাকে তুলবে। এরা কি গাড়িতে তোলার সময় চোখ বেঁধে তুলে? কেন তাকে শুধু শুধু তুলবে? সে তো কিছুই করে নি। সে কোন মিছিলে যায় নি। তার ভয় লাগে। সাতই মার্চের ভাষণ শোনার জন্যে রেসকোর্সের মাঠে যাবার ইচ্ছা ছিল, তবু যায় নি। তার মন বলছিল ঝামেলা হবে। লোকজন ছোটাছুটি শুরু করবে। মরতে হবে মানুষের পায়ের নিচে চাপা পড়ে।
জন্মাষ্টমীর রথযাত্ৰা উপলক্ষে বিরাট মেলা হয় নান্দিগ্রামে। ছোটবেলায় বাবার হাত ধরে সেই মেলা সে দেখতে গেল। কি প্ৰচণ্ড ভীড়া! যাতে হারিয়ে না। যায়। সে জন্যে সে দুহাতে শক্ত করে বাবার হাত ধরে রাখল। তারপরও সে হারিয়ে গেল। লোকজনের চাপে ছিটকে কোথায় চলে গেল। মেলার সবগুলো মানুষ যেন হঠাৎ পাগল হয়ে গেল। যে যে-দিকে পারছে ছুটছে। বেদেনীর সাপের ঝুড়ি থেকে দুটা কাল সাপ না-কি বের হয়ে পড়েছে। ছোটাছুটি এই কারণে। অনিল দৌড়াচ্ছিল চোখ বন্ধ করে। হঠাৎ কে যেন তাকে তাকে ধরে ফেলল। অনিল তাকাচ্ছে কিন্তু কিছু দেখছে না। তার চোখে সব দৃশ্য এলোমেলো হয়ে গেছে। শুধু সে শুনছে। বুড়ো এক ভদ্রলোক বলছেন, এই ছেলেটা এমন করছে কেন? এ কেমন যেন নীল হয়ে যাচ্ছে। এই ছেলেটাকে বাতাস কর। ছেলেটাকে বাতাস কর।
অনিল সারাজীবন সব রকম ঝামেলা থেকে দূরে থাকতে চেয়েছে। আর আশ্চর্য! বেছে বেছে তাকেই একের পর এক ঝামেলায় পড়তে হয়েছে। রূপেশ্বরে এক পাগলি আছে— মোক্তার পাগলি। সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে পথে পথে ঘুরে বেড়ায়। তাকে মোক্তার বললেই বাঘিনীর মতো ছুটে যায়। বাচ্চ-কাচ্চারা তাকে দেখলেই ঢ়িল ছুড়ে। মোক্তার বলে চিৎকার করে ক্ষেপায়। পাগলি তাদের তাড়া করে। অনিল কোনদিন মোক্তার পাগলিকে দেখে হাসে নি। তার গায়ে ঢ়িল ছুড়ে নি কিংবা মোক্তার বলে চোঁচায় নি। তারপরেও এই পাগল শুধু তাকেই খুঁজে বেড়াত। দেখা হলেই তাড়া করত। হয়ত সে বই নিয়ে স্কুলে যাচ্ছে। বটগাছের আড়ালে থেকে মোক্তার পাগলি বের হয়ে এল। বই-খাতা ফেলে অনিল ছুটছে। পেছনে পেছনে লম্বা লম্বা পা ফেলে ছুটছে মোক্তার পাগলি। রূপেশ্বরে এটা ছিল সাধারণ ঘটনা। কেউ অনিলকে সাহায্য করার জন্যে এগিয়ে আসত না। দূরে দাঁড়িয়ে মজা দেখত। কেউ কেউ হাততালি দিয়ে চেচাত- লাগ ভেলকি লাগ।