বাস হর্ন দিচ্ছে। যাত্রীরা সচকিত হয়ে উঠেছে। সামনেই মিলিটারী চেক পোস্ট। দুজন মিলিটারী রেইন কোট গায়ে রাস্তায় দুপাশে দাঁড়িয়ে আছে। বৃষ্টি থেমে গেছে। পরিষ্কার দিন।
মুক্তি চেঁচিয়ে কাঁদছে
মুক্তি চেঁচিয়ে কাঁদছে। তাকে কিছুতেই সামলানো যাচ্ছে না। মুক্তির বাবা মুক্তিকে কাঁধে নিয়ে দুলাচ্ছেন। কান্না কমার বদলে তাতে তার কান্না আরো বেড়ে যাচ্ছে।
সুট পরা ভদ্রলোক আবার বমি করছেন। এবার বমি করছেন গাড়ির ভেতর। তিনি গাড়ি প্ৰায় ভাসিয়ে দিয়েছেন। বিকট শব্দ হচ্ছে।
কালো পোশাক পরা একজন মিলিশিয়া উঁকি দিল। তার চেহারায় যথেষ্ট মায়া আছে। গলার স্বরও কোমল, অথচ সে কুৎসিত একটি বাক্য বলল, শোয়ার কি বাচ্চা, সব উতারো। ছব্বিশ জন্য যাত্রী এই বাসে। ছাব্বিশ জনের ভেতর একজনও বলতে পারল না- কেন অকারণে গালি দিচ্ছেন। সবাই এমন মুখ করে আছে যেন এই গালি তাদের প্রাপ্য। শুধু আয়ুব আলির চোখ মুখ শক্ত হয়ে গেল। আয়ুব আলির স্ত্রী চাপা গলায় বললেন, তোমার পায়ে ধরি। তুমি উল্টাপাল্টা কিছু বলব না। আমি তোমার পায়ে ধরি। ভদ্র মহিলা সত্যি সত্যি স্বামীর পা চেপে ধরলেন। প্রায় কেঁদে ফেলে বললেন, পুলাপানের কসম লাগে, উল্টাপাল্টা কিছু বলব না।
মহিলা যাত্রী ছাড়া বাকি সবাইকে লাইন করে দাঁড় করানো হয়েছে। স্যুট পরা ভদ্রলোক শুধু দাঁড়িয়ে থাকতে পারছেন না। তিনি ঝকঝকে স্যুট নিয়ে কাদার উপর বসে আছেন। তার হেঁচকি উঠছে। ব্রিফকেস এখনো তার হাতে ধরা।
অনিল লক্ষ্য করল তল্লাশির পুরো ব্যাপারটা মিশিটারীরা এক ধরনের খেলার মতো নিয়েছে। মজার কোন খেলা, যেখানে থেকে আনন্দ পাওয়া যায়। অন্তত এরা সবাই যে আনন্দ পাওয়ার চেষ্টা করছে তা বোঝা যাচ্ছে। সবার ঠোঁটের কোণেই হাসি কিংবা হাসির আভাস। এরা নিজেরা তীব্ৰ ভয়ের মধ্যে আছে। অন্যের ভয় থেকে আনন্দ পাওয়ার চেষ্টা তারা করবে, তা বলাই বাহুল্য। ভীত মানুষকে আরো বেশি ভয় পাইয়ে দেবার প্রবণতাও মানুষের মজ্জাগত।
মিলিটারী দলের প্রধান একজন অল্পবয়স্ক অফিসার। তিনি দূরে একটা টুলে বসে আছেন। এখানে কি হচ্ছে না হছে তা নিয়ে তার মাথা ব্যথা নেই, এরকম একটা ভাব। তল্লাশি দলের সঙ্গে একজন দোভাষী থাকে। এদের সঙ্গেও আছে। এই দোভাষী বিহারী নয়, বাঙালি। চল্লিশ পায়তাল্লিশ বছর বয়েসী একজন মানুষ। সার্ট প্যান্ট পরা। চোখে চশমা। তাকেও খুব হাসিখুশি দেখাচ্ছে। সে খানিকটা দূরে বসে কলা খাচ্ছে। তার সামনে একটা মগ। মগভর্তি চা।
তল্লাশি দল সুট পরা মানুষটার কাছে চলে এল। তাকেই যে প্রথম জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে তা বোঝাই যাচ্ছিল।
একজন সুবাদার শীতল গলায় বলল, ডরতা কেউ?
লোকটি সুন্দর উর্দুতে বলল, ভয় পাচ্ছি না। আমার শরীর খারাপ। কয়েকবার বমি হয়েছে। এই জন্যে দাড়াতে পারছি না।
কথাবার্তা সব উর্দুতে হল।
তুমি বাঙালি?
জ্বি জনাব বাঙালি।
না?
নাম।
আবু হোসেন।
কলেমা জান?
জি। চার কলমা জানি।
নামায পড়?
নামায পড়ি।
উর্দু কোথা শিখেছি?
আমরা ছোট বেলায় রাওয়ালপিন্ডি ছিলাম। বাবা রেলওয়েতে কাজ করতেন।
বাবার নাম কি?
ইসমাইল হোসেন।
তুমি পাকিস্তান ভালবাস?
জি বাসি।
ব্রিফকেসে কি আছে?
কিছু কাগজপত্ৰ আছে। জমির দলিল।
ব্রিফকেস খোল।
ব্রিফকেসের চাবি আনতে ভুলে গেছি জনাব।
সুবাদারের মুখ শক্ত হয়ে গেল। সে পাশে দাঁড়িয়ে-থাকা একজনকে কি যেন বলল। উর্দু নয় অন্য কোন ভাষায়। সম্ভবত পশতু। সে ব্রিফকেস নিয়ে গেল। ব্রীফকেস ভাঙা হতে লাগল। পুরো দলটি গভীর আগ্রহে ব্রিফকেস ভাঙা দেখছে। তাদের সবার চোখে মুখে স্পষ্ট আনন্দের ছাপ। টুলে বসে থাকা অফিসারও আগ্রহ বোধ করছেন। তিনি উঠে এসেছেন ব্রীফকেস ভাঙা দেখতে। সুট পরা লোকটি আবার বমি করছে। হড় হড় করে বমি। তার বমির দৃশ্যেও মিলিটারীর দল আগ্রহ বোধ করছে। এতেও যেন তারা খানিকটা মজা পাচ্ছে।
ব্রিফকেস ভাঙা হয়েছে। একটা জমির দলিল, কিছু কাগজপত্র, দাড়ি সেভ করার যন্ত্রপাতি, একটা গায়ে মাখা সাবান। খামে ভরা কিছু টাকা। উল্লেখযোগ্য পরিমাণের নয়। ছয় সাত শ হবে। মিলিটারীর তল্লাশি দলটির আশা ভঙ্গ হল। অফিসারটিও বিরক্ত হয়েছেন। তিনি কঠিন গলায় বললেন, এ মুসলমান কি-না ভালোমতো জিজ্ঞেস কর। চেহারা হিন্দুর মতো।
অফিসারের কথায় দলটির মধ্যে আবার খানিকটা আগ্রহ দেখা গেল। সুবাদার বলল, কলেমায়ে শাহাদৎ বল।
আবু হোসেন গড় গড় করে কলেমায়ে শাহাদৎ বলল।
খাৎনা হয়েছে?
জি।
প্যান্ট খোল।
আবু হোসেন অতি দ্রুত খুলে ফেলল। যেন এর জন্যেই সে অপেক্ষা করছিল। প্যান্ট খুলে দেখাতে পেরে যেন খানিকটা আরাম পাচ্ছে। বিপদ বুঝি-বা কাটল। সুবাদার বলল, যাও ক্যাপ্টেন সাহেবকে দেখিয়ে আসা। আবু হোসেন প্যান্ট খোলা অবস্থাতেই ক্যাপ্টেন সাহেবের সামনে গেল। ক্যাপ্টেন সাহেব উদাস দৃষ্টিতে একবার তাকালেন, তারপর হাত ইশারায় চলে যেতে বললেন। আবু হোসেন তার ভাঙা ব্রিফকেস নিয়ে বাসে উঠল এবং তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়ল। এমন শান্তির ঘুম সে অনেকদিন ঘুমায় নি।
জিজ্ঞাসাবাদ এখন বেশ তাড়াতাড়ি হচ্ছে। দুএকটা কথা জিজ্ঞেস করেই ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। কারোর প্যান্ট খোলা হচ্ছে না। একজনকে শুধু বলা হল একশ বার কানে ধরে উঠ- বোস করতে। এবং যতবার উঠে দাঁড়াবে ততবার বলবে, জয় বাংলা।