বাড়ি দূর আছে। এই খান থাইক্যা ধরেন চাইর মাইল।
মিলিটারী কি রোজই যাতায়াত করে?
হুঁ। যাতায়াত বাড়ছে।
বাসের চাকা লাগানো হয়ে গেছে। বাস হর্ন দিচ্ছে। বৃষ্টিও পড়তে শুরু করেছে। বাসে ফিরতে ফিরতে সবাই আধভেজা হয়ে গেল। বাস যখন ছাড়ল তখন মুষল ধারে বৃষ্টি। দুহাত দূরের জিনিস দেখা যায় না। এমন অবস্থা। আয়ুব আলি আনন্দিত গলায় বললেন, বৃষ্টিটা নেমেছে আল্লার রহমতের মতো। বৃষ্টিতে মিলিটারী বের হবে না। চেকিং ফেকিং কিছু হবে না। হুস করে পার হয়ে যাব।
বাস চলছে খুব ধীরে। উইন্ড শিল্ড দিয়ে কিছু দেখা যাচ্ছে না, ধীরে চলা ছাড়া উপায় নেই। আয়ুব আলি বললেন, আমি সামনে গিয়ে বসি, এইখানে খুব বাকুনি। মহসিন সাহেব। আপনি পা তুলে আরাম করে বসেনতো।
অনিল পা তুলে বসল। তেমন আরাম হল না। ক্ষুধা কষ্ট দিচ্ছে। শরীর ঝিম ঝিম করছে। আয়ুব আলি সাহেবের স্ত্রী, বোরকার পর্দা তুলে দিয়েছেন। স্বামী পাশে নেই এখন একটু সহজ হওয়া যায়। তিনি অনিলের দিকে তাকিয়ে বললেন, পান খাইবেন?
না।
একটাখান। মিষ্টি পান। জর্দা দেওয়া নাই।
অনিল পান হাতে নিল। ভদ্রমহিলা সুখী সুখী গলায় বললেন, ভাইয়ের বিয়ায় যাইতেছি। শ্রাবণ মাসের দশ তারিখ বিবাহ।
আমি শুনেছি।
মেয়ে খুব সুন্দরী। ছবি আছে দেখবেন?
দেখি।
ও পাপিয়া তোর নতুন মামীর ছবি দেখা।
পাপিয়া ছবি দিল। পাপিয়ার মা হাসি মুখে বললেন, গায়ের রঙ খুব পরিষ্কার, ছবিতে তেমন আসে নাই।
পাপিয়া বলল, তুমিতো দেখ নাই মা। সব শোনা কথা।
ছোট চাচা দেখছেন। ছোট চাচা বলছেন- বক পাখির পাখনার মতো গায়ের রঙ। ছোট চাচা মিথ্যা বলার মানুষ?
অনিল ছবির দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে গেল। কি সুন্দর ছবি। গোলগাল মুখ। মাথাটা বা পাশে হেলানো। বেণী বাঁধা চুল। টানা টানা চোখে রাজ্যের বিস্ময় ও আনন্দ। সামান্য ছবি এত কিছু ধরতে পারে?
সুন্দর না?
হ্যাঁ সুন্দর। খুব সুন্দর।
আমার ভাইও সুন্দর। ও পাপিয়া তোর মামার ছবি দেখা।
পাপিয়া আগ্রহ করে মামার ছবি বের করল। অনিলের এই ছবিটি দেখতে ইচ্ছে করছে না। অসম্ভব রূপবতী তরুণীর পাশে কাউকে মানাবে না। পৃথিবীর সবচে রূপবান তরুণকেও তারপাশে কদাকার লাগবে। কি আশ্চর্য মেয়েটাকে এখন অতসীদির মতো দেখাচ্ছে। অবিকল অতসীদির হাসির মতো হাসি। অতসীদির চোখের মতো চোখ। অতসীদির মতোই গোল মুখ। কে জানে হয়ত এই মেয়েটার নামও অতসী। অনিল পাপিয়াকে বলল, তোমার নতুন মামীর নাম কি?
পাপিয়া হাসতে হাসতে বলল, অহনা।
কি নাম বললে, অহনা?
জ্বি। আমার আব্বা বলে— গহনা। হিহিহি…
অনিলের এই সুখী পরিবারটিকে ভালো লাগছে। অসম্ভব ভালো লাগছে।
সবচে দুঃখের সময় আনন্দময় কল্পনা করতে হয়। সুরেশ বাগচী বলতেন, বুঝলি অতসী মানুষ কি করে জানিস? সুখে সময় সে শুধু সুখের কল্পনা করে। একটা সুখ তাকে, দশটা সুখের কথা মনে করিয়ে দেয়। দুঃখের সময় সে শুধু দুঃখই কল্পনা করে। এটা ঠিক না। উল্টোটা করতে হবে।
অতসীদি বলতো, তুমি বুঝি তাই করা?
সব সময় পারি না। তবে চেষ্টা করি। খুব আনন্দের কিছু যখন ঘটে তখন তোর মার কথা ভাবি। ইস বেচারী এই আনন্দ দেখার জন্যে নেই.. তখন চোখে জলে এসে যায়।
খুব আনন্দের কিছু কি তোমার জীবনে ঘটে বাবা?
অবশ্যই ঘটে। কেন ঘটবে না।
আমিতো আনন্দের ঘটনা কিছু দেখি না। কবে ঘটল বলতো? একটা ঘটনা বল।
ঐতো সেদিনের কথাই ধর। তোরা দুই ভাই বোন খুব হাসাহাসি করছিস। দেখে আমার মনটা আনন্দে ভরে গেল। সঙ্গে সঙ্গে তোর মার কথা ভাবলাম। একা একা খানিকক্ষণ কাঁদলাম।
বাবা, তোমার কি কোন গোপন দুঃখ আছে?
সুরেশ বাগচী হাসতে হাসতে বললেন, না মা আমার সব প্রকাশ্য দুঃখ। তোর বুঝি সব গোপন দুঃখ?
অতসী হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল। তারপরেই খিলখিল করে হেসে ফেলল।
অনিল তার দিদির অনেক গোপন দুঃখের খবর জানা না। শুধু একটি জানে। সেই দুঃখটা ভয়াবহ ধরনের। এই দুঃখের কথা পৃথিবীর কাউকেই জানানো যাবে। না। কোনদিন এটা নিয়ে আলোচনাও করা যাবে না। এই দুঃখ দূর করারও কোন উপায় নেই। কিছু গোপন দুঃখ আছে যা চিরকাল গোপন থাকে।
অতসীদির বিয়ের কথা উঠলে সে বলবে, আমি কিন্তু বিয়ে করব না। শুধু শুধু তোমরা চেষ্টা করছ।
কেন করবে না দিদি?
কেন করব না সে কৈফিয়ত তোর কাছে দিতে হবে? তুই কে? তুই কি আমার গুরু মশাই? করব না করব না, ব্যাস।
বিয়ে যদি ঠিকঠাক হয়ে যায় তুই কি করবি?
আমি তখন ছেলেটাকে দশ লাইনের একটা চিঠি লিখব। বিয়ে ভেঙে যাবে।
অনিল ঠিক জানে না। তবে তার অনুমান অতসীদি এ রকম একটা চিঠি লিখেছে। নয়ত নেত্রকোনার উকিল সাহেবের ছেলের সঙ্গে বিয়ে ভেঙে যেত না। সব ঠিক ঠাক। ওদের মেয়ে খুব পছন্দ। পণের কোন ব্যাপার নেই। উঁকিল সাহেব বিনা পণে ছেলের বিয়ে দেবেন। তাদের বংশের এরকম ধারা। ছেলের মা এবং বোনরা এসে আশীৰ্বাদ করে গেল। ছেলের মা অতসীকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কাঁদলেন এবং বললেন, এই মেয়েটাতো মানুষ না। এতো দেবী দুৰ্গা। এখন থেকে আমরা এই মাকে আমি দুৰ্গা ডাকব।
সেই বিয়ে ভেঙে গেল। ছেলে সুরেশ বাগচীকে লোক মারফত একটি চিঠি পাঠাল। তাতে লেখা
প্ৰণাম নিবেন। বিশেষ কারণে আমার পক্ষে বর্তমানে বিবাহ করা সম্ভব হইতেছে না। আপনি কিছু মনে করিবেন না। আমি অত্যন্ত দুঃখিত।
সুরেশ বাগচী বিস্মিত হয়ে বললেন, ব্যাপারটা কি? আমিতো কিছুই বুঝলাম না। ব্যাপারটা কি?