সুট পরা ভদ্রলোক হাতে ব্রিফকেস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তাকে অসম্ভব চিন্তিত মনে হচ্ছে। ভদ্রলোক তাকিয়ে আছেন রাস্তার দিকে। একটা ট্রাক হর্ন দিল। তিনি ভয়ানক চমকে উঠলেন। অনিল তাঁর দিকে তাকাতেই তিনি সরে গেলেন। মনে হচ্ছে তিনি কারো সঙ্গে কথা বলতে চান না।
মহসিন সাহেব। এই মহসিন।
অনিল তাকাল। আয়ুব আলি তাকেই ডাকছেন। অনিলের মনে ছিল না তার নতুন নামকরণ হয়েছে। আয়ুব আলি বাস থেকে নেমেছেন। এখন তার চোখের সান গ্ৰাস। এই সানগ্রাস আগে ছিল না।
মহসিন।
আমাকে বলছেন?
আপনাকে ছাড়া কাকে বলব? এর মধ্যে ভুলে গেছেন? শুনে যান। এদিকে, আর্জেন্ট কথা আছে।
অনিল এগিয়ে গেল। আয়ুব আলি গলার স্বর অনেকখানি নামিয়ে বললেন, অবস্থা খুব খারাপ।
কেন?
দুই বোরকাওয়ালীর সঙ্গে এক বুড়ো আছে না? এরা বিহারী!
কে বলল আপনাকে?
আপনারা সব নেমে গেলেন। হঠাৎ শুনি এই দুই বোরকাওয়ালী বেহারী ভাষায় কথা বলছে। শুনেই বুকটা ছ্যাৎ করে উঠল। আমি তো সহজ পাত্র না, কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম- আপনারা কি বিহারী? কথা বলে না। অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। এখন কি করা যায় বলেন তো?
করার কি আছে?
বোকার মতো কথা বলবেন না। স্পাই যাচ্ছে বুঝতে পারছেন না। আমি কান্না দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম— এটা বাঙালির কান্না না। একেক জাতির কান্না একেক রকম। বাঙালির কান্না বিহারী কাঁদতে পারে না। কিছু একটাতো করা দরকার।
আপনি চুপচাপ থাকুন। কিছুই করার নেই।
আমিও তাই ভাবছিলাম। পথে মিলিটারী, কিছু করা ঠিক হবে না। টাঙ্গাইলে নেমে না হয় বুড়োকে কানে ধরে উঠ-বোস করাবো। ঘরের শত্রু বিভীষণ।
অনিল কিছু বলল না। শরীরটা খারাপ লাগছে। এতক্ষণ বমি-বমি ভাব ছিল, এখন সত্যি বমি আসছে। বমি করে ফেলতে পারলে শরীরটা বোধ হয় ভালো লাগত। বমি হওয়ার জন্যেই অনিল আরেকটা সিগারেট ধরাল।
মহসিন সাহেব।
জ্বি।
ট্রিকস করে বুড়ো কাছ বুড়োর কাছ থেকে জানিব না-কি ব্যাপারটা কি?
কি দরকার?
তাও ঠিক। কি দরকার? তার উপর আবার বুড়ো মানুষ। জোয়ান হলে পাছায় লাথি দিয়ে নালায় ফেলে দিতাম।
বাসের চাকা বদল করা হচ্ছে। জ্যাকে কি এক সমস্যা। জ্যাক উপরে উঠছে না। ড্রাইভার এবং হেল্লার দুজনেই অনেক কায়দা-কানুন করছে। লাভ হচ্ছে না। পাপিয়া জানোলা দিয়ে হাত ইশারা করে তার বাবাকে ডাকল। অপ্ৰসন্ন মুখে আয়ুব আলি এগিয়ে গেলেন। ফিরে এলেন তার চেয়েও অপ্ৰসন্ন মুখে। থু করে একদলা থুথু ফেলে বললেন, মেয়েছেলে সঙ্গে নিয়ে কোথাও যাওয়াই উচিত না। কথায় আছে না- পথে নারী বিবর্জিতা। এসব কথাতো আর এমি এমি লোকজন বানায় না। দেখে শুনে বিচার বিবেচনা করে বানায়।
কি হয়েছে?
পাপিয়ার মা না-কি আসার সময় পানি বেশি খেয়েছিল, এখন বাথরুমে যাওয়া দরকার। তার জন্যে পাকিস্তানে গভর্নমেন্ট পথের মাঝখানে বাথরুম বানিয়ে বসে আছে। আমি পাপিয়ার মাকে বললাম- চুপ করে বসে থাক। একটা কথা না। বেশি কথা আমি নিজে বলি না, বেশি কথা শুনতেও পছন্দ করি না।
অনিল বলল, বাস এখানে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে বলে মনে হয়। কাছেই একটা বাড়ি দেখা যাচ্ছে সেখানে নিয়ে গেলে হয়।
কে নিয়ে যাবে, আমি?
আপনি যেতে না চাইলে আমি নিয়ে যাই।
মহসিন সাহেব, আপনার বয়স অল্প। আপনাকে একটা কথা বলি। মেয়েছেলের সব কথার গুরুত্ব দিবেন না। গুরুত্ব দিয়েছেন তো মরেছেন। এদের কথা এক কান দিয়ে শুনবেন, আরেক কান দিয়ে বের করে দেবেন। আচ্ছা এই শালারা একটা চাক্কা বদল বদল করতে গিয়ে ছয় মাস লাগিয়ে দিচ্ছে ব্যাপার কি?
অনিল, আয়ুব সাহেবের স্ত্রী, তাঁর দুই কন্যা এবং হাতাহাতি বিশারদ দুই পুত্রকে নিয়ে রাস্তার ওপারে বাড়িটার দিকে এগুচ্ছে। ভদ্রমহিলা পুরো ব্যাপারটায় খুব লজ্জা পাচ্ছেন। কিন্তু তাঁর মেয়ে দুটি বাস থেকে বের হতে পেরে উল্লসিত। তারা ক্ৰমাগত কথা বলে যাচ্ছে। সেই সব কথা বোঝার উপায় নেই। অল্প বয়স্ক বালিকাদের যেসব কোড ল্যাংগুয়েজ আছে তাই ব্যবহার করা হচ্ছে। ছেলে দুটি নীরব।
ভদ্রমহিলা কিছুটা গ্ৰাম্য টানা টানা স্বরে বললেন, পাপিয়ার বাবা আপনারে বিরক্ত করতেছে?
অনিল বলল, না।
ভদ্রমহিলা নিচু গলায় বললেন, আপনে কিছু মনে নিয়েন না। মানুষটা পাগলা কিসিমের কিন্তু অন্তর খুব ভালো।
মনে করার কিছু নেই।
কথা বেশি বলে কিন্তু বিশ্বাস করেন। খুব ভালো মানুষ।
আমি বিশ্বাস করছি। কেন বিশ্বাস করব না।
পাপিয়া বলল, ছোট বেলায় বাবার টাইফয়েড হয়েছিল। তার পর থেকে বাবা কথা বেশি বলে।
পাপিয়ার মা, কড়া গলায় বললেন, চুপ কর।
সম্পন্ন গৃহস্তের টিনের বাড়ি। কিন্তু বাড়িতে কোন মানুষ জনের সাড়া নেই। অনেক ডাকাডাকি পর কমলা শ্রেণীর একজন লোক বের হয়ে এল। তার কাছ থেকে জানা গেল রাস্তার দুপাশে অনেক দূর পর্যন্ত বাড়ি ঘরে কোন মানুষ থাকে না। রাস্তা দিয়ে মিলিটারী যাতায়াত করে। বেশ কয়েকবার ট্রাক থামিয়ে তারা রাস্তার আশেপাশের বাড়ি-ঘরগুলিতে ঢুকেছে।
অনিল বলল, বাড়িতে ঢোকে কি চায়?
লোকটা কিছু বলল না। আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকল।
অনিল বলল, ওরা কি টাকা পয়সা চায়?
না। মেয়েছেলের সন্ধান করে।
সে কি?
অছিমদ্দিন মেম্বার সাহেবের বউ আর ছোট শালীরে ট্রাকে উঠায়ে নিয়া গেছে। তারার আর কোন সন্ধান নাই।
অছিমদিন মেম্বার সাহেবের বাড়ি কোনটা?