বরুণ কঠিন গলায় বলল, দাদা, আমি ঠিক করেছি- কোলকাতা চলে যাব।
কি বললি?
শুনলেতো কি বললাম। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি কোলকাতা চলে যাব।
সুরেশ বাবু দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তুই সিদ্ধান্ত নিয়েছিস। আমি কিছু বললে তো সিদ্ধান্ত পাল্টাবি না। আমাকে বলা অর্থহীন।
তোমাকে বলছি, কারণ তোমাকে খবরটা জানানো দরকার।
আচ্ছা যা, আমি জানলাম।
তোমাকে সবাই স্যার স্যার করে, খাতির করে, কাজেই তুমি আছ একটা ঘোরের মধ্যে। আসল সত্য তোমার অজানা। এই দেশের সেনাবাহিনীতে কোন হিন্দু নেয়া হয় না, এটা তুমি জান?
না, জানতাম না।
এখন তো জানলে। এখন বল কি বলবে?
এরা যে নিচ্ছে না। এটা এ-দেশের মানুষদের বোকামি। দেশের সব সন্তানের সমান অধিকার। অধিকার থেকে বঞ্চিত করা এক ধরনের ভুল। সেই ভুলের জন্য দেশকে কেন দায়ী করব?
কাকে দায়ী করবে?
যেসব মানুষ এই ভুল করছে তাদের দায়ী করব।
শুধু দায়ী করবে, আর কিছু না?
ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করব যেন তারা ভুল বুঝতে পারে।
ঈশ্বর সঙ্গে সঙ্গে তোমার প্রার্থনা শুনবেন?
শোন বরুণ, আমি বুঝতেই পারছি না কেন তুই এত রেগে আচ্ছিস কেউ কি তোকে কিছু বলেছে?
না। দাদা, আমি চলে যাচ্ছি।
সেটা তো শুনলাম। কবে যাচ্ছিস?
আজই যাচ্ছি। আজ রাত এগারোটায়।
সুরেশ বাগচী দীর্ঘসময় চুপ করে থেকে বললেন, আজ রাত এগারোটায় তুই চলে যাচ্ছিস আর আমাকে সে-খবর দিতে এখন এসেছিস? বাড়িঘর কি করবি?
বাড়িঘর বিক্রি করে দিয়েছি।
কখন বিক্রি করলি?
মাস খানিক হল। সব চুপি চুপি করতে হল। জানাজানি হলে সমস্যা হবে।
আমাকেও জানালি না!
একজন জানলে সবাই জানবে।
সুরেশ বাগচী দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, এই দেশের কাউকেই তুই বিশ্বাস করিস না। শ্রীরামকৃষ্ণের একটা কথা আছে না? কচ্ছপের মতো মানুষ। তুই হচ্ছিস সে রকম। কচ্ছপ থাকে জলে কিন্তু ডিম পাড়ে ডাঙ্গায়। তুই থাকিস এক দেশে আর মন পড়ে থাকে অন্য দেশে। কাজেই তোর চলে যাওয়াই ভালো। তবে তুই যে শেষ সময়ে আমাকে খবরটা দিতে এলি তাতে মনে দুঃখ পেয়েছি।
তোমাকে আগে বললে লাভটা কি হত?
সুরেশ বাগচী দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, কোন লাভ হত না। যাচ্ছিস যা। ঐখানে মন টিকবে না। মানুষ গাছের মতো। মানুষের শিকড় থাকে। শিকড় ছিড়ে যাওয়া ভয়ংকর ব্যাপার। গাছ ছিড়লে যেমন মারা যায়, মানুষও মারা যায়। গাছের মৃত্যু দেখা যায়। মানুষেরটা দেখা যায় না। তুই দুঃখ পাবি।
দুঃখ তুমিও পাবে দাদা। দুদিন পর বুঝবে কি বোকামি করেছ। হিন্দুমুসলমান দাঙ্গা লাগবে, ঘরে আগুন দিবে।
এইটা কখনো হবে না। বরুণ। আমি কোনদিন এদের অবিশ্বাস করি নি। এরাও করবে না। তুই এখন যা, তোর সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগছে না।
বরুণ তারপরেও চুপ করে খানিকক্ষণ বসে রইল। তাকাল অতসীর দিকে। নিচু গলায় বলল, অতসী, আমি কি অতসীকে নিয়ে যাব?
ওকে নিতে চাস কেন?
ওরা ভালো বিয়ে দেব। এই দেশে ওর জন্যে ছেলে পাবে না।
তুই চলে যা বরুণ। এগারোটার সময় যাবি দশটা প্ৰায় বাজে।
তুমি আজ বুঝতে পারছ না। দাদা। একদিন বুঝবে। মর্মে মর্মে বুঝবে।
বরুণ চলে গেল। সুরেশ বাবু বারান্দায় সারা রাত বসে রইলেন। সেই রাতে তিনি উপবাস দিলেন। বিগড়ে গেলে শরীরকে কষ্ট দিয়ে মন ঠিক করতে হয়। সুরেশ বাগচী ঠিক করলেন আগামী দিনও তিনি নিরন্তু উপবাস দেবেন।
বাসের ঝাঁকুনিতে অনিলেরও ঘুম পেয়ে গেল। ঘুমের মধ্যেই মনে হল, সে দিন ছোট কাকার সঙ্গে দেশ ছেড়ে চলে গেলে তার এই বিপদ হত না। বাবা বেঁচে থাকতেন। তবে অনিল এও জানে, কোন উপায়ে সে যদি বাবাকে জিজ্ঞেস করতে পারত- বাবা, তোমার কি মনে হচ্ছে দেশ ছেড়ে গেলে তোমার জন্যে ভালো হত? থেকে যাওয়াটা বোকামি হয়েছে। তাহলে তিনি জবাব দিতেন— অনিল, এই বিপদ কোন ব্যক্তিবিশেষের উপর আসে কি, সারা দেশের উপর এসেছে। আমার মৃত্যু এমন কোন বড় ব্যাপার না বাবা। তাছাড়া তোমার হেড স্যার কি তোমাকে লেখেন নি আমার মৃত্যু সংবাদে রূপেশ্বরের হাজার হাজার মানুষ চোখের জল ফেলেছে। মানুষের ভালবাসায় আমার মৃত্যু। এই দুর্লভ সৌভাগ্য কজনের হয়?
সবাই এক সঙ্গে হৈ হৈ করে উঠল
সবাই এক সঙ্গে হৈ হৈ করে উঠল। বাস প্রচণ্ড একটা ঝাঁকুনি খেয়ে বাম দিকে খানিকটা হেলে টাল মাটাল অবস্থা এগুচ্ছে। ড্রাইভার প্রাণপণে ব্রেক করতে করতে বলল, হারামির পুত তোর মারে আমি…
বাসের একটা টায়ার ফেটে গেছে, দুর্ঘটনা পারত ঘটে নি। ফাঁকা রাস্তা বলেই সামলোনো গেছে। হেল্পার বলল, সব নামেন, গাড়ি খালি করেন। যার যার পিসাব করার দরকার পিসাব করেন।
অনিল নামল। আয়ুব আলি সাহেবের কনিষ্ঠ কন্যাকে কোলে বসানোয় অনিলের পায়ে ঝি ঝি ধরে গেছে। একটু হাঁটাহাঁটি করা দরকার। এত ঝাঁকুনিতেও আয়ুব আলির নেমে পড়েছে। শুধু মহিলারা গাড়িতে বসা। অনিলের সঙ্গে পাপিয়ার নামার ইচ্ছা ছিল। বাবার ভয়ে নামতে পারে নি।
অনিল ঘাসের উপর বসে সিগারেট ধরিয়েছে। সিগারেটে টান দিয়ে সে টের পেল আজ। সারা দিনে দুকাপ চা ছাড়া খায় নি। সিগারেটের ধোঁয়া পেটে পাক দিচ্ছে, বমি ভাব হচ্ছে। ভয়ংকর সময়েও ক্ষুধা নামক বিষয়টি মানুষের সঙ্গ ছাড়ে না। ফাঁসির আসামী ফাঁসির তিন ঘণ্টা আগে খেতে চায়। ফাঁসির আসামীকে যখন জিজ্ঞেস করা হয়— শেষ ইচ্ছা কি? বেশির ভাগই না-কি খাবারের কথা বলে।