এত কিছু পরেও ভদ্রলোক স্বস্তি পাচ্ছেন না। এক সময় দেখা গেল। গাড়ির জানোলা দিয়ে মুখ বের করে তিনি বিকট শব্দে বমি করছেন।
ঝাঁকুনি খেতে খেতে গাড়ি এগুচ্ছে। গাড়ির গতি বেশি না। এত খারাপ রাস্তায় গতি বেশি দেবার প্রশ্ন উঠে না।
ঢাকা থেকে বেরুবার মুখেই একটা চেকপোস্ট। চেকপোষ্টে মিলিশিয়ার কিছু লোকজন। ড্রাইভার গাড়ির গতি কমিয়ে দিল। যাত্রীরা শক্ত হয়ে বসে আছে। কেউ জানালা দিয়ে তাকাচ্ছে না। গাড়ির ভেতর কোন রকম শব্দ নেই। শুধুমাত্র ঘুমন্ত আয়ুব আলির নাক ডাকার শব্দ আসছে। বোরকা পরা মহিলাও কান্না থামিয়েছেন।
মিলিশিয়াদের একজন হাত ইশারা করে গাড়ি চালিয়ে যেতে বলল। কেউ এসে গাড়ির ভেতর উঁকি পর্যন্ত দিল না। কি অসীম সৌভাগ্য! গাড়ি চলতে শুরু করেছে। ছোট বাচ্চাটি কাঁদতে শুরু করেছে। কাঁদুক। ছোট বাচ্চারা তো কাঁদবেই।
রাস্তা এখন কিছুটা ভালো। ড্রাইভার গাড়িতে স্পীড দিতে শুরু করেছে। তাকে দ্রুত যেতে হবে। সন্ধ্যার আগে আগে টাঙ্গাইল পৌঁছতে হবে।
মুক্তি কাঁদছে। হাত-পা ছুঁড়ে কাঁদছে। মুক্তি যার নাম, অবরুদ্ধ নগরীতে যার জন্ম, সে তো কাঁদবেই। কাদাটাই তো স্বাভাবিক।
আয়ুব আলি
আয়ুব আলি অনিলের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমুচ্ছেন। তাঁর ছোট মেয়েটি অনিলের কোলে, সেও ঘুমুচ্ছে। আয়ুব আলি সাহেবের স্ত্রী বোরকার পর্দা তুলে ফেলে কৌতূহলী হয়ে চারপাশে দেখছেন। তাঁর মুখভর্তি পান। এরা বেশ সুখে আছে বলেই অনিলের মনে হল।
এই দেশ ছেড়ে সময়মতো চলে যেতে পারলে অনিলরাও কি সুখে থাকত? ১৯৬৫ সনে ইন্ডিয়া-পাকিস্তান যুদ্ধ লেগে গেল। তখন অনেকেই চলে গেল। অনিলের ছোট কাকা বরুণ বাগচী তাদের একজন। রূপেশ্বরে তিনি পাকা বাড়ি তুলেছিলেন, দোতলা বাড়ি। বাড়ির পেছনে পুকুর। চুপি চুপি সব বিক্রি করলেন। কেউ কিছুই জানল না। যে কিনল সেও কোন শব্দ করল না।
ছোট কাকার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক খুব ভালো ছিল না। টুকটাক ব্যবসা করেই কি করে যেন ধাই করে একদিন তিনি বড়লোক হয়ে গেলেন। আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে সম্পর্ক কমে গেল। তবু যাওয়া-আসা ছিল। কিন্তু তারা যে সব বিক্রি করে কোলকাতায় চলে যাচ্ছে এই সম্পর্কে কিছুই বলে নি। যে-রাতে যাবে সে-রাতে বরুণ বাগচী একা তাদের বাড়িতে বেড়াতে এল। তেমন শীত না, তবু সারা শরীর চাদরে ঢাকা।
সুরেশ বাবু বাংলা ঘরে বসে ছাত্র পড়াচ্ছিলেন, সেখান থেকেই বললেনকি খবর বরুণ?
তোমার সাথে একটু কথা আছে দাদা। ভেতরে আস।
ছাত্র পড়াচ্ছি তো।
একদিন ছাত্র না পড়ালে তেমন ক্ষতি হবে না। জরুরি কথা।
সুরেশ বাগচী অপ্ৰসন্ন মুখে উঠে এলেন। বরুণ গম্ভীর গলায় বলল, তোমার পুত্ৰ-কন্যাদেরও ডাক। কথাবার্তা সবার সামনেই হোক। এরা ছোট হলেও এদেরও শোনা দরকার। নয়ত বড় হয়ে আমাকে দোষ দিবে।
তোর ব্যাপার তো কিছুই বুঝতেছি না।
বরুণ বসল খাটে পা তুলে। তার গলার স্বর এমনিতেই ভারী। সে রাতে আরো বেশি ভারী শোনাল।
তোমরা ইন্ডিয়া চলে যাওয়ার কথা কিছু ভাবছ? সুরেশ বাবু অবাক হয়ে বললেন, শুধু শুধু ইন্ডিয়া চলে যাবার কথা ভাবব কেন?
অনেকেই তো যাচ্ছে।
অনেকেই কেন যাচ্ছে তাও তো বুঝি না।
কেন বুঝছ না? বেশিদিন মাস্টারি করলে মানুষের বুদ্ধি লোপ পায় জানি, এতটা পায় তা জানতাম না।
মাস্টারির দোষ দেয়ার প্রয়োজন নাই। তুই কি বলতে চাস বল।
বরুণ চাপা গলায় বলল, এই দেশ আমাদের থাকার জন্য না।
কেন না? তুই তো ভালোই আছিস। ব্যবসা-বাণিজ্য করছিস। দোতলা দালান দিয়েছিস।
তা দিয়েছি মনের শান্তির বিনিময়ের দিয়েছি। মনে শান্তি নাই।
শান্তি না থাকার মতো কি হল?
দাদা, তুমি বুঝতে পারছ না, এই দেশে আমরা সেকেন্ড ক্লাস সিটিজেন।
সুরেশ বাগচী হাসতে হাসতে বললেন, নিজেকে সেকেন্ড ক্লাস ভাবলেই সেকেন্ড ক্লাস। তুই এ রকম ভাবছিস কেন? আমাকে দেখ। আমি তো ভাবি না।
দাদা, সত্যি করে বল তো— তুমি কোন রকম অনিশ্চয়তা বোধ করা না?
না করি না। কেন করব?
কি আশ্চর্য কথা! একটা প্রশ্ন করলেই তুমি উল্টা প্রশ্ন করছ। আমি তো তোমার ছাত্র না।
তোর হয়েছে কি সেটা বল।
দাদা, তোমাকে সত্যি কথা বলি, এই দেশে মনটা ছোট করে থাকতে হয়।
যার মন ছোট, সে যে দেশেই যাক তার মন ছোটই থাকবে।
খবরের কাগজে দেখেছি। আরতীবালা নামের এক মেয়েকে কিছু প্রভাবশালী লোক ধরে নিয়ে গেছে, সাতদিন পর ছেড়েছে?
শুধু হিন্দু মেয়েদের এ রকম হচ্ছে তা তো না, মুসলমান মেয়েদের বেলায়ও হচ্ছে। হচ্ছে না? এমন যদি হত শুধু হিন্দু মেয়েদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ঘটছে তাহলে ভিন্ন কথা হত। তা ঘটছে না। আরতীবালাকে নিয়ে খবরের কাগজে প্রচুর লেখালেখি হয়েছে। ব্যাপারটা সবার খারাপ লেগেছে বলেই হয়েছে।
এটা একটা জঘন্য দেশ দাদা।
তুই যেখানে যাচ্ছিস সেটা কি খুব উন্নত কিছু? সেখানে এমন হচ্ছে না? সমস্যা তো দেশের না, সমস্যা মানুষের। দেশ মন্দ হয় না। মাটি কি কখনো মন্দ হয়?
বরুণ রাগী গলায় বলল, আমাকে এসব বড় বড় কথা বলবে না। দাদা। আমার এসব বড় বড় কথা শুনতে বিরক্তি লাগে।
আচ্ছা ঠিক আছে, আর বড় বড় কথা বলব না। তুই একটু সহজ হয়ে বসতো। তোর মাথা গরম হয়েছে। গা থেকে গরম চাদরটা খোল। লেবুর সরবত খাবি? অতসী তোর কাকাকে লেবুর সরবত করে দে।
আমি কিছু খাব না।
তুই কি অকারণে রাগোরাগি করার জন্যে এসেছিস?