গাড়ি হর্ন দিচ্ছে। শেষ পর্যন্ত ছাড়বে বলে মনে হচ্ছে। আয়ুব আলি উঠে দাঁড়ালেন। চায়ের দাম অনিল দিতে গেল। তিনি এমনভাবে তাকালেন যেন অত্যন্ত আহত হয়েছেন।
চায়ের দাম দিবেন মানে? আমার কি টাকার শর্ট না-কি? ভাই শুনেন, আপনাকে আমার পছন্দ হয়েছে। আপনিও দেখলাম। আমার মতো কম কথার মানুষ। পথে যদি চেকিং হয়— অনিল বাগচী নাম বলার কোন প্রয়োজন নাই। নাম জিজ্ঞেস করলে বলবেন— মহসিন। মহসিন হল আমার বড় শ্যালকের নাম। যে গাধাটার বিয়ে করছে। ঐ গাধাটার নাম। বলবেন যে আপনি বিবাহ করতে দেশে যাচ্ছেন। কেউ বিয়ে-শাদী করতে যাচ্ছে শুনলে এদের মন একটু নরম হয়। মারধোর করলেও গুলি করে মারে না। নাম মনে থাকবে তো? মহসিন। বিপদের সময় মানুষ আসল নামই ভুলে যায়, আর নকল নাম! গাড়িতে বসে কয়েকবার মনে মনে বলেন- মহসিন, মহসিন, মহসিন। দানবীর হাজি মোহাম্মদ মহসিনের নাম ইয়াদ রাখবেন, তাহলেই হবে।
বাসে উঠে নিজের জায়গায় বসতে বসতে আয়ুব আলি ছেলেমেয়েদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ইনি তোমার বড় মামা। ইনার নাম মহসিন।
আয়ুব আলি সাহেবের স্ত্রী বোরকার পর্দা তুলে অবাক হয়ে তাকালেন অনিলের দিকে। আয়ুব আলি বললেন, ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছ কেন? ড্যাব ড্যাব করে তাকানোর কিছু নাই। বোরকার পর্দা ফেল।
আয়ুব আলি সাহেবের যমজ বাচ্চা দুটি এখন মারামারি করছে না। দুজনেরই মুখ এবং হাত ভর্তি চকলেট। ছোট মেয়েটারও মুখ ভর্তি চকলেট। চকলেটের রস গড়িয়ে তার জামা মাখামাখি হয়ে গেছে। বড় মেয়েটা অনিলের দিকে তাকিয়ে বলল, এরা আপনার চকলেটের টিন খুলে ফেলেছে।
অনিল বলল, ভালো করেছে। তুমি চকলেট খাওয়া না? খাও, তুমিও খাও। তোমার নাম কি?
পাপিয়া।
কোন ক্লাসে পড়?
সিক্সে।
খুব ভালো।
পাপিয়া ভয়ে ভয়ে বলল, আমি ক্লাস ফাইভে বৃত্তি পেয়েছি।
বল কি? কি কর বৃত্তির টাকা দিয়ে?
কিছু করি না। বাবা টাকা নিয়ে যায়।
খুবই অনুচিত। তোমার নিজের টাকা অন্যে নিয়ে যাবে কেন?
আয়ুব আলি কোন কথা বলছেন না, কারণ কথা বলার মতো অবস্থা তার নেই। তিনি ঘুমিয়ে পড়ছেন। তাঁর নাক ডাকছে।
বাসের ড্রাইভার বলল, সবাই বিসমিল্লাহ বলেন। গাড়ি ছাড়তেছি।
সবাই শব্দ করে বলল, বিসমিল্লাহ।
গাড়ি ছেড়ে দিল।
ছোট্ট একটা শিশু কাঁদছে। দুমাস বয়স। সেই তুলনায় গলার শক্তি প্ৰশংসনীয়। শিশুটির কান্নার আওয়াজ ছাপিয়ে উঠেছে। বাবা এবং মা দুজনেই তাকে নিয়ে খুব বিব্রত বোধ করছে। এটিই তাদের প্রথম সন্তান। কপালে বড় করে কাজলের ফোটা দেয়া। সেই কাজলে সমস্ত মুখ মাখামাখি হয়ে গেছে। বাচ্চাটির বাবা তাকে কিছুক্ষণ কোলে রেখে শান্ত করার চেষ্টা করছে, কিছুক্ষণ করছে মা। লাভ হচ্ছে না।
একজন বলল, ছোট শিশু সঙ্গে থাকা ভালো। শিশুর উপর আল্লাহপাকের খাস রহমত থাকে। এই শিশুর কারণে ইনশাআল্লাহ কারো কিছু হবে না। আমরা জায়গামতো নিরাপদে পৌঁছাব।
বাবার মুখে আনন্দের আভা দেখা গেল। মার মুখেও নিশ্চয়ই আনন্দের হাসি। বোরকার কারণে সে হাসি দেখা যাচ্ছে না। বাচ্চার কান্না এখন আর কারো খারাপ লাগছে না, বরং ভাল লাগছে। কাঁদুক সে, কাদুকা। গলা ফাটিয়ে কাঁদুক।
একজন জিজ্ঞেস করল, ছেলে না মেয়ে?
বাবা লাজুক গলায় বলল, মেয়ে?
কি নাম রেখেছেন মেয়ের?
বাবা খানিকক্ষণ ইতস্তত করে বললেন, মুক্তি। বলেই অস্বস্তি নিয়ে চারদিকে তাকালেন। সেই অস্বস্তি ছড়িয়ে পড়ল যাত্রীদের সবার চোখে-মুখে।
ভালো নাম কি?
ভালো নাম ফারজানা ইয়াসমিন।
মিলিটারী নাম জিজ্ঞেস করলে ভালো নামটা বলবেন। ডাক নাম বলার প্রয়োজন নাই।
বাচ্চাটা কান্না থামিয়েছে।
বৃদ্ধ ভদ্রলোকের সঙ্গের বোরকা পরা মহিলার কান্না শোনা যাচ্ছে। বৃদ্ধ তাকে এখন আর পাখার হাওয়া করছেন না। গাড়ির ভেতর প্রচুর হাওয়া। বৃদ্ধ চোখ বন্ধ করে বসে আছেন। মনে হচ্ছে তিনিও ঘুমিয়ে পড়েছেন। আকাশে মেঘ দেখা যাচ্ছে। রোদে তেজ নেই। বাতাস আর্দ্র, বৃষ্টি আসবে বলে মনে হচ্ছে। রাস্তা ভালো না, গাড়ি খুব ঝাঁকুনি দিচ্ছে। ঝাঁকুনিতে অনেকেরই ঘুম পেয়ে যাচ্ছে।
যাত্রীদের প্রায় সবার হাতেই কিছু না কিছু বই। বেশ কয়েকজনের হাতে কোরান শরীফ। অনেকের হাতে প্রচ্ছদে কায়দে আযমের ছবিওয়ালা বই। এ সব বই এখন খুব বিক্রি হচ্ছে। এসব বই হাতে থাকলে একধরনের ভরসা। পাওয়া যায়। মনে হয়, বিপদ হয়ত বা কাটবে।
প্ৰচণ্ড গরমে সুৰ্যটে পরা একজন বাসযাত্রী যাচ্ছেন। লাল রঙের টাই, থ্রি পিস সুট। কোটের পকেটে লাল গোলাপের কলি। তেকোনা লাল রুমাল। সঙ্গে একটা ব্রিফকেস। তিনি ব্রিফকেস কোলে নিয়ে বসেছেন। এক মুহুর্তের জন্যেও হাতছাড়া করছেন না। ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করতে গেলেন বখশি হাট বাজারের কাছে তাকে নামিয়ে দেয়া যাবে কি-না। তখনো ব্রিফকেস হাতে ধরা। ভদ্রলোককে খুব নার্ভাস মনে হচ্ছে, খুব ঘামছেন। একটু পর পর রুমাল দিয়ে মুখ মুছছেন, ঘাড় মুছছেন। জানোলা দিয়ে ঘন ঘন থুথু ফেরছেন। তাঁর সঙ্গে পানির বোতল আছে। মাঝে মাঝে বোতল থেকে পানি খাচ্ছেন।
এই প্ৰচণ্ড গরমে সুট পরে আসার রহস্য হল তিনি শুনছেন মিলিটারীরা ভদ্রলোকদের তেমন কিছু করে না। সুট পরা থাকলে খাতির করে। তারপরেও তিনি ঢাকা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যানের কাছ থেকে চিঠি নিয়ে এসেছেন। চিঠিতে লেখা–
— মোহাম্মদ সিরাজুল করিম, পিতা মৃত বদরুল করিম, গ্রাম বখশি হাট, আমার পরিচিত। সে পাকিস্তানের এজন খাদেম। দেশ ভক্ত এক ব্যক্তি। পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষায় সে জীবন কোরবান করতে সর্বদা প্ৰস্তৃত। আমি তাহার সর্বাঙ্গিণ মঙ্গল কামনা করি। পাকিস্তান জিন্দাবাদ।