স্ত্রীর এই পরামর্শ আয়ুব আলির মনে ধরল। তিনি তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়ালেন। অনিলের দিকে তাকিয়ে বললেন, ব্রাদার, আসেন চা খাবেন। অনিলও উঠে দাঁড়াল। ছেলে দুটির একটি অন্যটির কান কামড়ে ধরেছে। ছেলেদের মা, কান ছাড়াবার চেষ্টা করছেন। আয়ুব আলি নির্বিকার ভঙ্গিতে বললেন, খেয়ে ফেল। কামড় দিয়ে কান খেয়ে ফেল। যন্ত্রণা কমুক।
আয়ুব আলি নামার সময় সবাই ঘাড় ঘুরিয়ে কৌতূহলী চোখে তাকে দেখল। ভদ্রলোক ইতোমধ্যেই সবার কৌতূহল আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়েছেন। ক্ৰন্দনরত বোরকা পরা মহিলার কাছে এসে তিনি থমকে দাঁড়িয়ে বললেন, মা, কান্নাকাটি যা করার এখন করে নেন। মিলিটারী চেকিংয়ের সময় গলা দিয়ে টু শব্দ বের করবেন না। এরা অনেক কিছু সন্দেহ করে বসতে পারে। শেষে বিপদে পড়ে যাবেন। আর মা যদি কিছু মনে না করেন- ফর্সা পা দেখা যাচ্ছে। যদি মোজা থাকে মোজা পরে নেন। সুন্দরী মেয়ে দেখলে হারামজাদাগুলোর ইস থাকে না। যদি বেয়াদবী কিছু করে থাকি নিজগুণে ক্ষমা করে দেবেন।
বাস স্ট্যান্ডের লাগোয়া দুটি স্টল। দুটিই ফাঁকা। একটিতে রেডিও বাজছে, খবর হচ্ছে খুব চিকণ গলায় একজন মহিলা খবর পড়ছেন ; আয়ুব আলি সেটিতেই ঢুকলেন। অনিল পেছনে পেছনে গেল। রেডিওর প্রধান খবর হল, নদ-নদীতে পানি বাড়ছে। কোনটিতে কত পানি বাড়ছে তা বলা হল। বন্যার সম্ভাবনা সম্পর্কে বলা হল। উরুগুয়েতে মৃদু ভূমিকম্প হয়েছে। রেক্টর স্কেলে যার মাত্রা ৩.৪, এই তথ্যও জানা গেল। তারপর বলা হতে লাগল নিউ মেক্সিকোতে সড়ক দুঘর্টনায় এগারো ব্যক্তির নিহত হবার সংবাদ।
আয়ুব আলি মুখ বিকৃত করে বললেন, শালা।
অনিল বলল, কাকে বলছেন?
রেডিওটারে বললাম, নিজের দেশের খোঁজ নাই, অন্য দেশে এগারো জন নিহত। আরে শালা, তোর দেশে কয়টা নিহত সেইটা বল।
অনিল হেসে ফেলল এবং খুবই আশ্চর্য হল যে এই অবস্থাতেও সে হাসতে পারছে। তার মধ্যে এই মুহুর্তে কোন দুঃখবোধ আছে বলে মনে হচ্ছে না। পথের বিপদ নিয়েও সে ভাবছে না। কিছুই ভাবছে না। আয়ুব আলি স্টলের মালিকের দিকে তাকিয়ে কড়া গলায় বলেন, রেডিও বন করেন।
দোকানের মালিক ঠাণ্ডা গলায় বলল, রেডিও খোলা রাখা লাগে। কোন সময় কি বলে জানা দরকার। ধরেন, হঠাৎ কাফুর্ঘ্য দিল তখন কি করবেন? খাইবেন কি চা-নাশতা?
চা দাও। কাপ গরম পানি দিয়া ধুইয়া দিবা। চিনি কম।
যাইবেন কই আপনারা?
তা দিয়া আপনার প্রয়োজন নাই। চা দিতে বলছি চা দেন। চা দিয়া দাম নেন। অধিক কথা বলার সময় এখন না।
রেডিওতে নজরুল গীতি হচ্ছে। নজরুলের প্রেমের গান, নয়ন ভরা জল গো…
বিপ্লবী গানগুলো বাজানো হচ্ছে না। স্বাধীন বাংলা বেতার বাজাচ্ছে বিপ্লবী গান।
পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী নজরুলের প্ৰেম বিষয়ক সংগীতে এমন খুব উৎসাহী। হামদ এবং নাতে উৎসাহী, উচ্চাঙ্গ সংগীতে উৎসাহী।
আয়ুব আলি চায়ে চুমুক দিয়ে বলেন, ভাইসাব, আপনার নামটা তো জানা হল না। নাম জানা দরকার।
আমার নাম অনিল।
কি বললেন, অনিল?
জ্বি, অনিল বাগচী।
খাইছে আমারে। হিন্দু না-কি?
জ্বি।
সাহস তো কম না। হিন্দু হয়ে বাসে করে রওনা দিলেন? চেকিং-এ ধরা পড়বেন। এরা চার কলমা জিজ্ঞেস করে। প্যান্ট খুলে দেখে খৎনা হয়েছে কি-না। জানেন না?
শুনেছি।
আপনার কোন দিকে যাওয়ার দরকার না— যেখানে ছিলেন সেখানে চলে যান। আর যদি ট্রেনে-বাসে যেতে হয় তবে আগে গোপনে খৎনা করায়ে ফেলেন। এর মধ্যে লজ্জা-শরমের কিছু নাই। জান বাঁচান ফরজ। আমি অনেক হিন্দু ছেলের কথা জানি খৎনা করায়ে ফেলেছে। চার কলমা মুখস্থ করেছে। আপনার কলমা কয়টা মুখস্থ?
একটা শুধু জানি।
আমি জানি মোট দুটা। চাপে পড়ে তিন নম্বরটা মুখস্থ শুরু করলামখালি বেড়াছেরা লাগে। তবে দুটা জানলেও চলে, এরাও দুটার বেশি জানে না। একটু সুর দিয়ে, দরদ-টারদ মাখায়ে কেরাতের মতো পড়লেই এরা খুশি। বেকুবের জাত তো। বেকুবের জাত অল্পে খুশি হয়, অল্পে বেজার হয়। ঠিক বললাম না?
জ্বি।
শুধু বেকুব না। এরা হল হায়ওয়ানের জাত। হায়ওয়ান কি জানেন? হায়ওয়ান হল পশু। এরা পশুর জাত। পশু না হলে প্যান্ট খুলে খৎনা কেউ দেখে? বলেন। আপনি, দেখে? এটা কি মানুষের কাজ না পশুর কাজ? আমি তো ঠিক করে রেখেছি। কেউ যদি আমার প্যান্ট খুলতে বলে প্যান্ট খুলব, তারপর হিস করে হারামজাদার মুখে পেশাব করে দেব। এরপর যা হয় হবে। মৃত্যু কপালে থাকলে হবে। কি বলেন?
অনিল কিছু বলল না। আয়ুব আলি বিড়ির প্যাকেট বের করে বললেন, নিন, বিড়ি ধরান। বিড়িতে একটা টান দেন। মাথা পরিষ্কার হোক। হিন্দু মানুষ, সময়মতো হিন্দুস্থানে চলে গেলে ঝামেলা হত না। এতক্ষণ বাড়িতে বসে আরাম করে কচ্ছপের কোরমা খেতেন। ভালো কথা অনিল বাবু, কচ্ছপের কোরমা হয়?
জানি না হয় কি-না।
গভীর আগ্রহ নিয়ে আয়ুব আলি জিজ্ঞেস করলেন, কচ্ছপের মাংস খেতে কেমন? গোসতের মতো না মাছের মতো?
অনিল নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমার প্রচণ্ড মাথা ধরেছে। কথা বলতে ভালো লাগছে না।
সময়টাই খারাপ রে ভাই, সময়টাই খারাপ। কারোর কথা বলতে ভালো লাগে না। আমি তো বলতে গেলে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছি। চুপচাপ ঘরে থাকি। এর মধ্যে বড় শালার বিয়ে লেগে গেল। আরো ব্যাটা বলদ, এটা বিয়ে করার সময়? বড় শালি আবার একটা বাচ্চা দিয়ে ফেলল। মেয়ে বাচ্চা। নাম রেখেছে পি। আমাকে বলল, দুলাভাই, নামটা সুন্দর না? আমি বললাম, পি আবার কেমন নাম? পিসাব হলেও একটা কথা ছিল। বুঝতাম। ঘন ঘন পিসাব হয় বলে নাম পিসাব। এই শুনে সে আমার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। মেয়ের আকিকা করেছে আমাকে বলে নাই। কত বড় ছোটলোকের জাত চিন্তা করে দেখেন।