মোবারক।
ইয়েস স্যার।
কফি।
কফি কামিং স্যার।
ভালো লাগছে না। কিছু ভালো লাগছে না।
বাস শেষ পর্যন্ত ছাড়বে
বাস শেষ পর্যন্ত ছাড়বে কি-না বোঝা যাচ্ছে না। এগারোটায় এই বাস ছাড়বে এমন কথা ছিল। যাত্রী উঠে বসে আছে। বাস ছাড়ছে না। এখন বাজছে একটা। সমস্যা কি তাও বোঝা যাচ্ছে না। ভূয়াপুর থেকে একটা বাস এসে পৌঁছেছে বারটায়। তার ড্রাইভার কানে কানে অন্য ড্রাইভারকে কি সব বলেছে। ড্রাইভাররা বাস ছাড়ছে না।
অনিল জায়গা পেয়েছে একবারে পেছনের সিটে। এক কোণায় সে, বাকি সবটা জুড়ে এক পরিবার বসে আছেন। বোরকা পরা এক মহিলা, তাঁর স্বামী, এগারো-বারো বছরের একটি মেয়ে। আট বছর বয়েসী দুটি ছেলে, জমজ। অবিকল এক রকম দেখতে। এরা নিঃশব্দ, তবে খুব চালু। নিঃশব্দে নিজেদের মধ্যে মারামারি করে চলছে। চার বছর বয়েসী একটি বাচ্চা মেয়ে। ভাইদের মারামারি সে আগ্রহ নিয়ে দেখছে এবং খুব মজা পাচ্ছে বলে মনে হয়।
পরিবারের কর্তা বসেছেন অনিলের পাশে। ভদ্রলোকের বয়স চল্লিশের উপর। তিরিক্ষি মেজারের মানুষ। প্রচুর কথা বলেন। মারামারিরত দুই পুত্রের দিকে তাকিয়ে তিনি হুংকার দিয়ে বললেন, কর মারামারি কর। খামচোখামচি কর। খামচি দিয়ে একজন আরেকজনের চোখ তুলে ফেল। কিন্তু খবরদার, টু শব্দ করতে পারবি না। শব্দ করলে কচুকাটা করে ফেলব। আমার নাম আয়ুব আলি। আমার এক কথা। গলা দিয়ে শব্দ বের করেছিস কি মরেছিস।
বড় মেয়েটি বাবার পাশে বসেছে। সে নিচু গলায় বলল, মা বলছে তার গরম লাগছে। বোরকা খুলে ফেলতে চায়।
খবরদার, বোরকা যেমন আছে তেমন থাকবে। যখনকার যে নিয়ম। এখনকার নিয়ম বোরকা। গরমে সিদ্ধ হলে উপায় কিছু নাই। মিলিটারীকে বলতে বলিস যে গরম লাগছে। মিলিটারী পাংখা দিয়ে হাওয়া করবে।
গাড়ি ছাড়বে কি ছাড়বে না কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। গাড়ির হেল্পার এসে বলে গেলা— নাও যাইতে পারে। সামনে অসুবিধা আছে। মালিক আসন্তাছে। মালিক আসলে উনি যা বলবেন তাই হবে। উনি যাইতে বললে যাব। যাইতে না বললে নাই।
যাত্রীরা সবাই বসে আছে। কেউ নড়ছে না। বোঝাই যাচ্ছে সবারই যাওয়া প্রয়োজন। ড্রাইভারের সিটের ঠিক পেছনে বোরকা পরা দুজন মহিলা যাত্রী যাচ্ছেন। বৃদ্ধ এক ভদ্রলোক তাদের নিয়ে যাচ্ছেন। তিনি বোরকা পরা মহিলা একজনকে তাল পাখায় ক্রমাগত হাওয়া করছেন। মহিলাটি কাঁদছেন ফুঁপিয়ে। এক সেকেন্ডের জন্যেও থামছেন না। বোরকা পরা অন্য মহিলা গাড়ির জানালায় মাথা রেখে চুপচাপ বসে আছেন। কৌতূহলী যাত্রীরা বেশ কবার জিজ্ঞেস করেছে কি হয়েছে। বৃদ্ধ কঠিন গলায় বলেছেন, কিছু হয় নাই।
পুরো গাড়িতে অনিল ছাড়া যুবক কেউ নেই। যুবকরা বাসে ট্রেনে চলাচল করে না। প্ৰায় স্টেশনেই ট্রেনের কামরা চেক করা হয়। যুবকদের নামিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। হাতের মাসল টিপে দেখা হয়। হাত শক্ত কি-না। শক্ত হলে অস্ত্ৰ-ট্রেনিং নিয়েছে। সামান্যতম সন্দেহ হলে যুবকরা ফিরে আসে না।
বাসের জন্যেও চেক পোস্ট আছে। মিলিশিয়া নামের এক বস্তুর সম্প্রতি আমদানি হয়েছে। কালো কুর্তা পরে, কোমরে বাধা থাকে গুলির বেল্ট। এরা ইংরেজিও জানে না, উর্দুও জানে না। বিচিত্ৰ ভাষায় কথা বলে। এরা ভয়ংকর চরিত্রের মানুষ এই জাতীয় কথা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। কালো পোশাকের মিলিশিয়া চোখে পড়লে মানুষের বুকে ধ্বক করে ধাক্কা লাগে।
আয়ুব আলি বিড়ি ধরালেন। মেয়েটি বলল, বাবা, মা বিড়ি ফেলতে বলছে। বিড়ির গন্ধে মার বমি আসতেছে।
আয়ুব আলি মুখ বিকৃত করে বললেন, বমি আসলে বমি করতে বল। তোর মায়ের হুকুমে এখন দুনিয়া চলবে না। সে জেনারেল টিক্কা খান না।
আয়ুব আলি অনিলের দিকে ফিরে বললেন, ব্রাদার, আপনার কি অসুবিধা হচ্ছে?
না।
আপনার অসুবিধা হলে ফেলে দিতাম। কিন্তু পরিবারের কথায় আমি পয়সায় কেনা বিড়ি ফেলে দিব, তা হয় না। আপনি যাবেন কই?
রূপেশ্বর।
কোন রূপেশ্বর?
অনিল পুরো ঠিকানা বলল।
টাঙ্গাইল পৌঁছতে পৌঁছতেই তো রাত হয়ে যাবে। রূপেশ্বর যাবেন কীভাবে?
রাতে রাতে যাব। হেঁটে চলে যাব।
এইটাই ভালো। রাতে রাতে যাওয়া ভালো। মিলিটারী বলেন আর মিলিশিয়া বলেন সন্ধ্যার পর তারার পাতলা পায়খানা শুরু হয়ে যায়। সন্ধ্যার পর গলায় গামছা দিয়ে টেনেও এদের বের করতে পারবেন না।
মেয়েটি বলল, বাবা, মা এসব কথা বলতে নিষেধ করতেছে।
তোর মারে চুপ থাকতে বল। কি বলব কি বলব না সেটা আমার বিষয়। ভাই সাহেব, বিড়ি খাবেন?
জ্বি-না।
খেলে খেতে পারেন। এক সুটকেস ভর্তি বিড়ি নিয়ে নিয়েছি। এই যে যাচ্ছি। যদি আটকা পড়ে যাই! কিছুই তো বলা যায় না?
যাচ্ছেন কোথায়?
শ্বশুর বাড়ি যাচ্ছি। আমার এক শ্যালক বিয়ে করবে। আমি বড় জামাই। না গেলে বিয়ে হয় না। তা ভাই বলেন, এটা কি বিয়ের সময়? মাছির মতো মানুষ মরতেছে আর তুই ব্যাটা বউয়ের সাথে…আচ্ছা যা, বিয়ে করবি কর। তা আমি এমন কি রসগোল্লা দুলাভাই যে আমি ছাড়া বিবাহ হবে না। আরো ব্যাটা, আমরা যে তোর কারণে এতগুলা মানুষ যাচ্ছি। যদি পথে ভালো-মন্দ কিছু হয়! ধরা যদি তোর বোনরে মিলিটারী পথে নামায়ে রেখে দেয় তখন কি অবস্থােটা হবে? আমার শ্বশুরবাড়ির প্রত্যেকটা মানুষ গাধা। একবারে গ আকারে গা, ধ আকারে ধা।
মেয়েটি বলল, বাবা, মা বলছে নিচে গিয়া চা খেয়ে আসতে।