জোবায়েদ আরেক দফা কফি দিতে বল। আজ সাত কাপ কফি খাওয়া হবে। সাত কাপ কপি, সাতটা সিগারেট। খুব খারাপ একটা দিনের শুরু হচ্ছে। খুব খারাপ দিন। কর্নেল এলাহী কতক্ষণ এখানে থাকবে বোঝা যাচ্ছে না। মানুষটাকে এই মুহূর্তে অসহ্য বোধ হচ্ছে।
কর্নেল এলাহী!
ইয়েস মাই ফ্রেন্ড।
তুমি কফি খেয়েই বিদেয় হবে। আমার অতি জরুরি কিছু কাজ আছে। তুমি না গেলে তা করতে পারছি না।
অফকোর্স বিদেয় হব। রাতে কি তুমি ফ্রি আছ?
কেন বল তো?
অফিসার্স মেসে ছোট্ট একটা পার্টি হবে। খুব এক্সকুসিভ।
পার্টিতে যেতে বলছ? হ্যাঁ। তোমার মন মরা ভাব কাটানো দরকার। পার্টিতে সেই চেষ্টা সাধ্যমতো করা হবে। সন্ধ্যায় বাসায় থাকবে। আমি নিজে এসে নিয়ে যাব। চমৎকার কফি।
অনিল বড় সাহেবের জন্যে অনেকক্ষণ ধরেই অপেক্ষা করছে। কর্নেল সাহেব বসে আছেন বলে যেতে পারছে না। কয়েকটি কারণে বড় সাহেবের সঙ্গে তার দেখা প্রয়োজন। হাতে টাকা-পয়সা নেই। কিছু যদি পাওয়া যায়। তাছাড়া বড় সাহেবকে সে পছন্দ করে। নিজেও জানে না। চাকরির ইন্টারভ্যু দিতে এসে সে খুবই দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিল। প্রায় কুড়ি জনের মধ্যে তার বিদ্যাই সবচে কম।
ইন্টারভ্যু বোর্ডে জোবায়েদ সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, আপনার সঙ্গে কি কোন প্ৰশংসাপত্ৰ আছে?
অনিল প্রায় অস্পষ্ট স্বরে বলল, একটা আছে কিন্তু আমি স্যার দিতে চাচ্ছি না।
কোন দিতে চাচ্ছেন না?
প্ৰশংসাপত্রটা আমার বাবার দেয়া। আমি কারো কাছ থেকে প্ৰশংসাপত্ৰ জোগাড় করতে পারি নি, কাজেই বাবাই একটা লিখে দিলেন।
কি করেন আপনার বাবা?
স্কুল শিক্ষক।
প্ৰশংসাপত্রটা দেখি।
অনিল খুবই অস্বস্তির সঙ্গে হাতে লেখা কাগজটা এগিয়ে দিল। তার ধারণা ছিল, প্ৰশংসাপত্রটা পড়ে তিনি হেসে ফেলবেন এবং বোর্ডের অন্য মেম্বারদের দেখাবেন। কারণ প্ৰশংসাপত্রে লেখা–
যাহার জন্যে প্ৰযোজ্য
একজন পিতাই তাহার পুত্রকে সঠিক চিনিতে পারেন। মা ভাল চিনিতে পারেন না, কারণ সন্তান নয় মাস গৰ্ভে ধারণ করিবার কারণে মায়ের চিন্তা ভালবাসায় আচ্ছান্ন হইয়া থাকে। ইহাই স্বাভাবিক। একজন পিতা সেই ক্ৰটি হইতে মুক্ত। আমি অনিল বাগচীর পিতা। সে যোগ্যতায় বলিতেছি- আমার পুত্রের ভেতর সততার মতো বড় একটি গুণ পূর্ণ মাত্রায় আছে। সে তেমন মেধাবী নহে। তাহার মেধা সাধারণ মানের। ঈশ্বর মানুষকে পরিপূরক গুণাবলি দিয়ে পাঠান। সেই কারণেই আমার পুত্রের মেধার অভাব পূরণ করিয়াছে তাহার সততা। অন্য কোন গুণ আমি আমার পুত্রের ভিতর লক্ষ্য করি নাই। যাহা লক্ষ্য করিয়াছি তাহাই বলিলাম।
বড় সাহেব প্ৰশংসাপত্ৰ ফিরিয়ে শুকনো গলায় বললেন, আচ্ছা। আপনি যেতে পারেন।
অনিল বাড়ি চলে এল। দশদিনের মাথায় রেজিস্ট্রি ডাকে চিঠি দিয়ে তাকে জানানো হল যে চাকরি দেয়া হয়েছে। তার পোস্টিং হবে লন্ডন ব্ৰাঞ্চে। তবে কাজ শেখার জন্যে তাকে এক বছর ঢাকা অফিসে থাকতে হবে।
অনিল মুখ শুকনো করে বলল, লন্ডনে আমি গিয়ে থাকব কি করে? অসম্ভব। আমি এই চাকরি করব না। মরে গেলেও না।
এই সংসারে না বলে সহজে পার পাওয়া যাবে যায় না। সুরেশ বাগচী স্কুল থেকে রিটায়ার করেছেন। সংসার অচল। অনিলকে ঢাকায় আসতে হল।
মোবারক এসে অনিলকে বলল, কর্নেল সাহেব চলা গিয়া।
অনিল উঠল। বড় সাহেবের সঙ্গে দেখা করবে। এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে। দিনের আলো থাকতে থাকতে টাঙ্গাইল পৌঁছানো দরকার। রাস্তাঘাট কেমন কিছুই জানে না।
জোবায়েদ সাহেব চোখ তুলে তাকালেন। অনিল বলল, স্যার আসব?
আস।
স্যার, আমি একটু দেশে যাব। ছুটি চাচ্ছি।
দেশে যাবার মতো রাস্তাঘাট কি এখন নিরাপদ?
নিরাপদ না হলেও যেতে হবে। আমার বাবাকে স্যার মিলিটারীরা মেরে ফেলেছে। বোনটা আছে। অন্য এক বাড়িতে।
বস।
অনিল বসল। জোবায়েদ সাহেব নিয়ম ভঙ্গ করে আরেকটা সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, আমি শুনেছি। রাস্তাঘাট এখন মোটেই নিরাপদ না। আমি শুনেছি বাস থেকে যাত্রীদের নামানো হয়। জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। যাদের কথাবার্তায় এরা সন্তুষ্ট হয় না তাদের অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। আর কোন খোঁজ পাওয়া যায় না।
আমিও শুনেছি স্যার।
এই অবস্থায় রিস্ক নেয়া কি ঠিক? বেঁচে থাকাটা জরুরি। ইচ্ছে করে রিস্ক নেয়া বোকামি।
অনিল কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমার জায়গায় আপনি হলে কি করতেন স্যার? ঢাকায় বসে থাকতেন?
বড় সাহেব ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, না। আমি রওনা হয়ে যেতাম।
আমি তাহলে স্যার উঠি?
আগামীকাল গেলে কি তোমার চলে? তুমি যদি আগামীকাল যাও তাহলে মিলিটারীর কাছ থেকে আমি একটা পাশ জোগাড় করে দিতে পারি। কর্নেল এলাহী আমার বিশেষ বন্ধু।
মিলিটারীর কাছ থেকে কোন পাশ নেব না স্যার।
ঠিক আছে। তাহলে দেরি কর না, রওনা হয়ে যাও। মে গড বি উইথ ইউ। এক প্যাকেট চকলেট আমার কাছে আছে, এটা নিয়ে যাও।
অনিল হাত বাড়িয়ে চকলেটের টিন নিল।
তোমার নিশ্চয়ই কিছু টাকা পয়সা দরকার। ক্যাশিয়ারকে বলে দিচ্ছি, এক হাজার টাকা নিয়ে যাও। যদি আমরা দুজন বেঁচে থাকি আবার দেখা হবে।
যাই স্যার।
অনিল দরজা পর্যন্ত গিয়ে থমকে দাঁড়াল। জোবায়েদ সাহেব বললেন, কিছু বলবে?
অনিল না সূচক মাথা নাড়ল। জোবায়েদ সাহেব লক্ষ্য করলেন ছেলেটি নিঃশব্দে কাঁদছে। কাঁদুক। কিছুক্ষণ কাঁদুক। তিনি আনিলের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিলেন। সান্ত্বনার কিছু বলা দরকার। একটি বাক্যও মনে আসছে না। তিনি আরেকটি সিগারেট ধরালেন। আজ সব গণ্ডগোল হয়ে যাচ্ছে। তিনি একের পর এক সিগারেট টেনে যাচ্ছেন। মাথা ধরেছে। প্ৰচণ্ড যন্ত্রণা হচ্ছে।