জোবায়েদ সাহেব ঠিক নটার সময় অফিসে আসেন। তাঁর ঘরে চুপচাপ বসে থাকেন। এক ঘণ্টা পর পর কফি খান। এক কাপ কফি, একটা সিগারেট। বেলা একটার মধ্যে পাঁচটা সিগারেট এবং পাঁচ কাপ কফি খাওয়া হয়। একটা বাজার পাঁচ মিনিট পর তিনি অফিস থেকে বের হন। বাড়ি চলে যান। বাকি সময়টা বাড়িতেই থাকেন। বাড়ি থেকে বের হন না। গত দুমাস ধরে এই তাঁর রুটিন। এক মাস আগে পরিবারের সবাইকে করাচি পাঠিয়ে দিয়েছেন। তার ধারণা এক সময় হঠাৎ করে পশ্চিম পাকিস্তানে যাবার চাপ সৃষ্টি হবে। বিমানের টিকিট পাওয়া যাবে না। তাঁর ধারণা সচরাচর ভুল হয় না। তিনি নিজে যাবার কথা ভাবতে পারছেন না। কারণ তাঁর সম্পদ চারদিকে ছড়ানো। সিলেটে চা বাগানে ত্ৰিশ পার্সেন্ট শেয়ার কেনা আছে। দিলখুশা এলাকায় কিনেছেন পাঁচ বিঘা জমি। এই জমি সোনার খনির মতো। বিশ বিঘা জমি নারায়ণগঞ্জে কেনা আছে। একটা ফ্যাক্টরি দেবার কথা ভাবছিলেন। দুটি বাড়িও ঢাকা শহরে তাঁর আছে। সেই তুলনায় করাচিতে কিছুই নেই। তিনি অতি বিচক্ষণ লোক হয়েও এই বড় ভুলটি করেছেন। সম্পদ এই অংশে তৈরি করে যাচ্ছেন।
দেশ যদি সত্যি সত্যি স্বাধীন হয়ে যায় তাহলে কি হবে? ইন্ডিয়া দখল করে নেবে? সেই সম্ভাবনা কতটুকু? এখনো বুঝতে পারছেন না। ইন্ডিয়া কি এত বড় ভুল করবে? মনে হয় না। এই দেশের মানুষগুলোর ইন্ডিয়া প্রসঙ্গে কোন মোহ নেই। যারা ইন্ডিয়ায় আশ্রয় নিয়েছে, তাদের উপর দেশের মানুষ খানিকটা বিরক্ত বলেই মনে হয়।
বড় সাহেবের দরজার পর্দা ফাঁক করে মোবারক ঢুকল। হাসিমুখে বলল, কর্নেল সাব আয়া।
জোবায়েদ সাহেব বিরক্ত হলেন। তাঁর বিরক্তির কারণ দুটি। এক, কর্নেল সাহেবের সঙ্গে তিনি কথা বলতে চাচ্ছেন না। দুই, মোবারক এখন আর বাংলা বলছে না। মোবারক অবাঙালি কিন্তু কথা বলত বাংলায়। নিখুঁত ঢাকাইয়া বাংলায়। কিছুদিন হল সে আর বাংলা বলছে না। দাঁত বের করে যখন-তখন হাসছে। মনে হচ্ছে পুরো দেশটা সে তার চকচকে গোলাপি শার্টের পকেটে ঢুকিয়ে বসে আছে। এখন নিশ্চিন্ত মনে জর্দা দিয়ে পান খেয়ে ঠোঁট লাল করা যায়।
জোবায়েদ সাহেব গম্ভীর মুখে বললেন, আমাদের কফি দাও।
মোবারক পান খাওয়া লাল দাঁত বের করে বলল, কফি তুরন্ত আ যায়ে গি।
কর্নেল এলাহী শুধু খালি হাতে আসেন নি। একটা চকলেটের টিন নিয়ে এসেছেন। বিদেশি চকলেট, বেশ দামি জিনিস। তিনি কখনো খালি হাতে আসেন না। এর আগের বার এসেছিলেন আন্তর নিয়ে। তাদের ভেতর কথাবার্তা ইংরেজিতে হল।
এলাহী ঃ তোমার মুখ এমন গম্ভীর কেন? ব্যবসার হাল কি ভালো না?
জোবায়েদ ঃ না। ব্যবসা মন্দা।
এলাহী ঃ খুব সাময়িক ব্যাপার। কয়েকটা দিন যাক, দেখবে ব্যবসা হু হু করে বাড়বে।
জোবায়েদ ঃ কয়েকটা দিন মানে কত দিন?
এলাহী ঃ এই ধর তিন মাস।
জোবায়েদ ঃ তিন মাসে সব ঠিক হয়ে যাবে?
এলাহী ঃ ঠিক তো এখনই হয়ে গেছে। থানায় থানায় আমাদের লোক আছে। এখন হচ্ছে কম্বিং অপারেশন। প্রতিটি মানুষকে এক এক করে দেখা হচ্ছে।
জোবায়েদ ঃ কম্বিং অপারেশনের পর কি হবে?
এলাহী ঃ কি হবে তা কর্তা ব্যক্তিরা ঠিক করবেন। আমি অতি ক্ষুদ্র মৎস্য। তবে আমার যা অনুমান ওদের শায়েস্তা করার পর একটা রাজনৈতিক সমাধানের দিকে যাওয়া হবে। এক ধরনের আই ওয়াশ আর কি। হা-হা-হা। তখন ওদের যা বলা হবে তাতেই তারা রাজি হবে। দুদু খাবে?— বললে ওরা বলবে, খাব। তোমাক খাবে?- বললেও ওরা বলবে, খাব।
জোবায়েদ ঃ তোমাদের অবস্থা তাহলে ভালো।
এলাহী ঃ ভালো মানে? একসেলেন্ট! Can no be better.
জোবায়েদ ঃ শুনছি। তোমরা মেয়েদের উপর অত্যাচার করছ- এটা কি ঠিক?
এলাহী ঃ কোথেকে শুনিছ? ইন্ডিয়া বেতার?
জোবায়েদ ঃ হ্যাঁ, বিবিসিও বলছে।
এলাহী ঃ তুমি কি আজকাল প্রপাগাণ্ডা। নিউজ শোনা ধরেছ? সবচে বড় ক্ষতি করছে এই সব প্রপাগাণ্ডা। নিউজ।
জোবায়েদ ঃ তাহলে তোমরা মেয়েদের উপর কোন অত্যাচার করছ না?
এলাহী ঃ কিছু কিছু হয়ত হচ্ছে। ওয়ার ফেয়ারে এগুলো হয়। আমরা তো হাড়ুড়ু খেলছি না। যুদ্ধ করছি। এরা আমাদের শত্রুপক্ষ। এই দেশের মেয়েরা তো আমার শ্যালিকা নয়। শ্যালিকাদের সঙ্গেও যেখানে ফষ্টি-নষ্টি করার সুযোগ আছে সেখানে এদের সঙ্গে কেন করা হবে না। তুমি আমাকে বল।
কফি চলে এসেছে। কর্নেল এলাহী কফিতে চুমুক দিয়ে তৃপ্তির ভঙ্গি করল। জোবায়েদ সিগারেট ধরাল। এই সিগারেটটা বাড়তি। আজ একটার ভেতর ছয়টা সিগারেট খাওয়া হয়ে যাবে। কফিও এক কাপ বেশি খাওয়া হবে। জোবায়েদের বিরক্তি-ভাব বাড়ছে। তিনি সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বললেন, কর্নেল এলাহী!
বলে ফেল।
তুমি নিজে কি কোন বাঙালি মেয়েকে রেপ করেছ? ঠিকঠাক জবাব দাও। তোমার হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। আগুন হাতে নিয়ে মিথ্যা বলাটা ঠিক হবে না।
মিথ্যা বলতে চাচ্ছি। এই ধারণা তোমার হল কেন? মিথ্যা বলার তো তেমন প্রয়োজন দেখছি না। মেয়েদের সঙ্গ পেয়েছি। এবং পাচ্ছি। তবে আমি বাড়ি থেকে মেয়ে ধরে এনে রোপ করি না। উপহার হিসেবে আমার কাছে পাঠানো হচ্ছে।
কারা পাঠাচ্ছে?
এই দেশের মানুষই পাঠাচ্ছে। হা-হা-হা। হিন্দু মেয়েদের সম্পর্কে আমার খানিকটা আগ্রহ ছিল। কামাসূত্রার দেশের কন্যা, না-জানি কি। মাই ডিয়ার ফ্রেন্ড। অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। এরা হচ্ছে মোস্ট অর্ডিনারী। আরেক কাপ কফি দিতে বল। তোমার এখানে দেখি অসাধারণ কফি তৈরি হয়।