- বইয়ের নামঃ অনিল বাগচির একদিন
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ শিখা প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, কল্পকাহিনী, ইতিহাস
কেউ কি হাঁটছে বারান্দায়
কেউ কি হাঁটছে। বারান্দায়?
পা টিপে টিপে হাঁটছে? অনিল বাগচী শুয়েছিল, উঠে বসল। তার শরীর ঝিম ঝিম করছে, পানির পিপাসা লেগেছে। সামান্য শব্দেই তার এখন এমন হচ্ছে। শরীরের কলকজা সম্ভবত সবই নষ্ট হয়ে গেছে। মাথার ভেতরটা সারাক্ষণ ফাঁকা লাগে। তার নাক পরিষ্কার, সর্দি নেই, কিছু নেই, কিন্তু এই মুহুর্তে সে হা করে মুখ দিয়ে নিঃশ্বাস নিচ্ছে।
আবার পায়ের শব্দ। শব্দটা কি বারান্দায় হচ্ছে না। রাস্তায় হচ্ছে? অনিলের কান এখন খুব তীক্ষ্ণ। অনেক দূরের শব্দও সে এখন পরিষ্কার শুনতে পায়। হয়ত রাস্তায় কেউ হেঁটে যাচ্ছে। কিন্তু রাতের বেলা কে হাঁটবে রাস্তায়? এখনকার রাত অন্যরকম রাত। দরজা জানালা বন্ধ করে বসে থাকার রাত। রাস্তায় হেঁটে বেড়াবার রাত না।
কা-কা শব্দে কাক ডাকল। অনিল ভয়ংকর চমকে উঠল। এমন চমকে উঠার কিছু না। একটা কাক তার জানালার বাইরে বাসা বেঁধেছে। সে তো ডাকবেই, কিন্তু কা-কা করে শব্দটা ঠিক যেন তার মাথার ভেতর হয়েছে। কাকটা যেন তার মগজে পা রেখে দাঁড়িয়েছিল। কা-কা ডেকে ঠোঁট দিয়ে অনিলের মাথার মগজ খানিকটা ঠোকরে নিল। ব্যথায় শরীর পাক খাচ্ছে। চোখে পানি এসে যাচ্ছে। পিপাসায় বুক শুকিয়ে কাঠ।
এতটা ভয় নিয়ে বেঁচে থাকা কি সম্ভব? এরচে মরে যাওয়া কি অনেক সহজ না? বাড়ির ছাদে উঠে রাস্তায় লাফিয়ে পড়লে কেমন হয়? ছাদে উঠার দরজাটা কি খোলা? মেসের মালিক কামাল মিয়া ভারি ভারি সব তালা লাগিয়েছেন। সদর দরজায় ভেতর থেকে দুটা তালা লাগানো হয়। ছাদে যাবার দরজাও নিশ্চয়ই বন্ধ। সেখানেও তালা।
অনিল হাত বাড়িয়ে পানির জগ নিল। তার গ্রাস ভেঙে গেছে, জগে৷ মুখ লাগিয়ে পানি খেতে হয়। শোবার সময় সে জগ ভর্তি করে পানি এনে রাখে। কিছুক্ষণ পর পর কয়েক ঢোক করে পানি খায়। ভোরের মধ্যে পানির জগ শেষ হয়ে যায়।
ভয়। তীব্র ভয়। সারাক্ষণ ভয়ে অনিলের শরীর কাপে। সে অবশ্যি জন্ম থেকেই ভীতু ধরনের। ছোটবেলায় অন্ধকারে কখনো ঘুমুতে পারত না। বাতি জ্বলিয়ে রাখতে হত। সে সময়টা আবার ফিরে এসেছে। এখন সে অন্ধকারে ঘুমুতে পারে না। রাত এগারোটার পর বাতি নিভিয়ে দিতে হয়। সে জেগে থাকে। মাঝে মাঝে অন্ধকার অসহ্য বোধ হলে বালিশের নিচে রাখা টর্চ জ্বালায়। তীরের মতো আলোর ফলা দেয়ালের নানান জায়গায় ফেলে। ঘরের অন্ধকার তাতে কমে না। খুব সামান্য অংশই আলোকিত হয়। বাকি ঘরে আগের মতোই অন্ধকার থাকে। অন্ধকার কমে না। অনিলের ভয়ও কমে না। অনিল বালিশের নিচ থেকে দু ব্যাটারীর টর্চটা বের করল। আলো ফেলল দেয়ালে। আলো তেমন জোরালো না। ব্যাটারি কিনতে হবে। কি কি কিনতে হবে তা দিনে মনে থাকে না। রাতে শুধু মনে হয়। টর্চের ব্যাটারি, একটা পানির গ্লাস, মোমবাতি, কাগজ, লেখার কাগজ। কাল রাতে চিঠি লেখার ইচ্ছা করছিল। কাগজের অভাবে চিঠি লেখা হয় নি।
অনিল টেবিলে রাখা টেবিল ঘড়িটিতে আলো ফেলল। রাত বেশি না, কিন্তু মনে হচ্ছে নিশুতি। সে এবার আলো ফেলল দেয়ালে। আলোটা পড়ল ঠিক ক্যালেন্ডারটার উপর। ওষুধ কোম্পানির চোখে বাংলাদেশ। পালতোলা নৌকা যাচ্ছে। মাঝি হাল ধরে বসে আছে। তার মুখভর্তি হাসি। তার হাসি মনে হতে পারে নৌকার হাল ধরে বসে থাকার মধ্যেই জীবনের পরম শান্তি।
ক্যালেন্ডারে পাশেই স্বামী বিবেকানন্দের বাধানো ছবি। অনিলের বাবা এই ছবি ছেলেকে উপহার হিসেবে দিয়েছেন। ছবিটির নিচে বিবেকানন্দের। এটি বাণী লেখা। বাণীটি হচ্ছে- যে ঈশ্বর মানুষকে ইহকালে ক্ষুধার অন্ন দিতে পারেন। না। তিনি পরকালে তাদের পরম সুখে রাখবেন তা আমি বিশ্বাস করি না।
ছবির বিবেকানন্দ রাগী চোখে তাকিয়ে আছেন। ঘরের যে দিকে যাওয়া যাক মনে হবে স্বামীজী সে দিকেই তাকিয়ে আছেন। রাগ ছাড়াও তার চোখের ভাষায় এক ধরনের ভৎসনা আছে। তিনি যেন বলছেন, রে মূৰ্থি, জীবনটা নষ্ট করছিস কেন?
অনিল টর্চ লাইটের আলো নিভিয়ে ফেলল। ছবিটা সরানো দরকার। নষ্ট করে ফেলা দরকার, কিংবা লুকিয়ে ফেলা দরকার। বিবেকানন্দের ছবি ঘরে রাখা এখন ভয়াবহ ব্যাপার। ছবিটা সরাতে হবে। এখনই কি সরাবে? আবার কাক ডাকল। অনিল ভয়ে একটা ঝাকুনি খেল। অনিলের বাবা রূপেশ্বর মডেল হাই স্কুলের ইংরেজির শিক্ষক সুরেশ বাগচী, ছেলের চরিত্রে অস্বাভাবিক ভয়ের ব্যাপারটি লক্ষ্য করেই বোধহয় ছেলের খাতায় একদিন বড় বড় করে লিখে দিল–
Cowards die many times before their death.
গম্ভীর গলায় বললেন, রোজ সকালে এই লেখাটার দিকে তাকিয়ে থাকবি। ধ্যান করবি। লেখাটার মানে হল— ভীতুদের মৃত্যুর আগেও অনেকবার মৃত্যুবরণ করতে হয়। যে সে মানুষের লেখা না। শেকসপিয়ারের লেখা। দেখি শেকসপিয়ার বানান কর তো? সুরেশ বাগচীর অভ্যাসই হচ্ছে যে কোন কথা বলেই ফন্ট করে বানান জিজ্ঞেস করা। অনিল ক্লাস গ্ৰীতে যখন পড়ে তার পেটে তীব্র ব্যথা শুরু হল। সুরেশ বাবু ছেলেকে কোলে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাচ্ছেন। পথে নেমেই বললেন, ব্যথা বেশি হচ্ছে বাবা?
অনিল কাঁদতে কাঁদতে বলল, হুঁ।
খুব বেশি?
হুঁ।
আচ্ছা বাবা বল তো ব্যথার ইংরেজি কি?