হোসেন মিয়ার গোপন মতলবের দুটো একটার খবর যে জেলেপাড়াব লোকেরা রাখে না তা নয়। জেলেপাড়ার তিনটি পরিবার উধাও হইয়া গিয়াছে। হোসেন মিয়া যে ছেলে বুড়ো স্ত্রী পুরুষ নির্বিশেষে এক একটি সমগ্র পরিবারকে কোথায় রাখিয়া আসিত প্রথমে কেহ তাহা টের পায নাই, পরে জানা গিয়াছিল নোয়াখালির ওদিকে সমুদ্রের মধ্যে ছোটো একটি দ্বীপে প্রজা বসাইয়া সে জমিদারি পত্তন করিতেছে। সে দ্বীপ নাকি গভীর জঙ্গলে আবৃত, শহর নাই, গ্রাম নাই, মানুষেব বসতি নাই, শুধু আছে বন্য পশু এবং অসংখ্য পাখি।
কিছু কিছু জঙ্গল সাফ করিয়া এই দ্বীপে হোসেন মিযা ঋণগ্রস্ত উপবাসপিন্ন পরিবারদের উপনিবেশ স্থাপন করিতেছে। লোভ দেখাইযা, আশা দিয়া, এক একটি নিরুপায় পরিবাবকে সে এই দ্বীপে লইয়া যায়, সৃষ্টির দিন হইতে কখনও আবাদ হয নাই এমন খানিকটা জমি দেয়, থাকিবার জন্য ঘর দেয়, আবাদের জন্য দেয় হাল বলদ ও জঙ্গল কাটিবার জন্য যন্ত্রপাতি। অন্যান্য স্থান হইতে আরও কতগুলি পরিবারকে সে ওখানে লইয়া গিয়াছে কে জানে, কেতুপুরেব জেলেপাড়াব তিনঘর মাঝিকে সে যে আদিম অসভ্য যুগের চাষায পরিণত করিয়াছে এ খবর জেলেপাড়ার কারও অজানা নাই। তবু, জানা না জানা তাহাদেব পক্ষে সমান। মাথা নিচু করিয়া তাহারা হোসেন মিয়ার দেওয়া উপকার গ্রহণ করিবে। মনুষ্যবাসের অযোগ্য সেই দ্বীপকে জনপদে পরিণত করাব আহ্বান আসিলে যতদিন পারে মাথা নাড়িয়া অস্বীকার করিবে, যেদিন পরিবে না সেদিন স্ত্রী-পুত্রের হাত ধরিযা নিঃশব্দে হোসেন মিয়ার নৌকায় গিয়া উঠিবে।
তাই মনে মনে লোকটাকে ভয় করিলেও কাছে গিয়া কুবের বলিল, ছালাম মিয়া বাই।
হোসেন বলিল, ছালাম। কেমন ছিল মাঝি? কাহিল মালুম হয়?
জ্বরে ভুগলাম। কইলকাতার থনে আলেন কবে?
আইজ আলাম। আর গণেশ বাই, খবর কি? মেলায় যারা না?
গণেশ ঢোঁক গিলিয়া বলিল, যামু মিয়া বাই, মেলায় যামু। পোলাপানেরা মেলায় যাওনের লেইগা খেইপা আছে, না গেলে চলব ক্যান?
গুমটি দিছে, বাদাম চলব না। সকাল সকাল রওনা দিবা। বদর কইয়ো মাঝি, সাঁঝের আগে ফিরা আইয়ো, আসমান ভালো দেখি না। শুইনা আলাম আজকালির মদ্যি জবর ঝড় হইবার পারে।
কুবের আকাশের দিকে ও নদীর দিকে চাহিল। পাতলা কুয়াশার মতো মেঘ আকাশ ভরিয়া আছে, নিস্তরঙ্গ পদ্মার বুকে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টিপাতে অসংখ্য ছোটো ছোটো বুদবুদ উঠিয়া ফাটিয়া গেলে যেমন দেখায় তেমনি দেখাইতেছে। নদীর অপর তীর চোখে পড়ে না, নদীর মাঝখানের নৌকা পর্যন্ত অস্পষ্ট। আরও এদিকে একটি স্পষ্টতর নৌকার দিকে চোখ রাখিয়া কুবের সংক্ষেপে প্রশ্ন করিল, যামু না মেলায়? বারণ করেন নাকি মিয়া বাই?
হোসেন বলিল, যারা না ক্যান? ডর কিসির? আসমান দেইখা রওনা দিবা, আসমান দেইখা ফিরবা। বাদলা দিনে ঝড় জানান দিয়া আহে।
সায় দিয়া কুবের নৌকায় উঠিল। মুসলমান মাঝির দুটি নৌকা ইতিমধ্যেই মেলায় যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হইয়াছিল, দুটি নৌকাই একসঙ্গে ছাড়িয়া গেল। নদীর জল তুলিয়া নৌকা ধুইতে ধুইতে কুবের একসময় চাহিয়া দেখিল, হোসেন চলিয়া গিয়াছে। চালার জন্য অবিলম্বে প্রয়োজনীয় শণের কথাটা এতক্ষণে তাহার মনে পড়িয়াছে, হোসেনকে বলিয়া রাখিলে ভালো হইত। লোকটা এই আছে, এই নাই! শণের জন্য কাল সকালে হয়তে ওর বাড়ি গিয়া শুনিবে, রাতারাতি ও ঢাকায় পাড়ি দিয়াছে! কবে ফিরিবে? কে তাহা জানে!
হোগলার ছাউনিটা বাতার সঙ্গে বাঁধিতে বাঁধিতে কুবের হঠাৎ সচকিত হইয়া বলিল, কে হাঁকে রে গণশা?
বহুদুর নদীবক্ষ হইতে হাঁক আসিতেছিল, মানবকণ্ঠের একটানা একটা ক্ষীণ আওয়াজ। দুই কানের পিছনে হাত দিয়া হাঁক শুনিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া কুবের সাড়া দিয়া উঠিল। এ এক ধরনের ভাষা, পূর্ববঙ্গের মাঝিশ্রেণির লোক ছাড়া এ ভাষা কেহ জানে না। এ ভাষায় কথা নাই, আছে শুধু তরঙ্গায়িত শব্দ। উন্মুক্ত প্রান্তরে, বিস্তৃত নদীবক্ষে এ শব্দ দূর হইতে দূরে চলিয়া যায়, ক্ষীণ হইতে ক্ষীণতর হইয়া আসে কিন্তু তরঙ্গের তারতম্য অবিকল থাকিয়া যায়। অস্ফুট গুঞ্জনের মতো মৃদু হইয়াও যদি কানে আসিয়া লাগে পদ্মানদীর মাঝি কান পাতিয়া শুনিয়া অর্থ বুঝিতে পারে। শব্দের দুলক্ষ্য উৎসের দিকে চাহিয়া সে বুক ভরিয়া বাতাস গ্রহণ করে। বা হাত কানের পিছনে রাখিয়া, ডান হাতটি মুখের সম্মুখে আনিয়া সঞ্চালিত করিয়া উচ্চারিত একটানা আওয়াজে সে তরঙ্গের সৃষ্টি করে।
ধনঞ্জয় মন দিয়া শোনে নাই। সে জিজ্ঞাসা করিল, কেডা? কী কয়?
কুবেব কহিল, আমাগোর রাসু।
ধনঞ্জয় অবাক হইয়া গেল।
বিন্দা মাঝির পোলা? কস কি কুবির! শুনছস নি ঠিক?
রাসুর গলা চিনি না খুড়া? অখনি আইবো, দেইখো।
ধনঞ্জয়ের বিস্ময় কমিতে চায় না। বহুদূরের নৌকাটির দিকে চাহিয়া সে বলিল, রাসু না হোসেন মিয়ার দ্বীপে গেছিল?
হ।
আইল কিবা?
কুবের বিরক্ত হইয়া কহিল, কিবা কমু খুড়া? আহুক, জিগাইয়ো। হোসেন মিয়া ছাইড়া দিবাব পাবে, ও নিজে পলাইয়া আইবার পারে, না জিগাইয়া নি কওন যায়?
খানিক পরে আবার হাঁক আসিল, এবার আরও স্পষ্ট। হাঁকের আওয়াজে যে একটি উৎসুক সুর ছিল তিনজনের কানেই তাহা ধরা পড়িল। গণেশ কুবেরের মুখের দিকে চাহিয়া কী বলিতে হা করিয়া কিছুই বলিল না। হাঁকের জবাব দিবার জন্য কুবের সুদীর্ঘ শ্বাস গ্রহণ করিল।