হ। কম য্যান লাগে।
বলিয়া মালা উৎসুক চোখে গোপির পায়ের দিকে চাহিয়া থাকে। অনেকক্ষণ পরে সলজ্জভাবে বলে, মনে এউক্কা সাধ ছিল মাঝি। কমু?
হ, এমনইভাবে ভনিতা করে মালা। মালার তামাটে মুখখানা একটু রাঙা দেখায়। আস্তে আস্তে সে জিজ্ঞাসা করে কুবেরকে, হাসপাতালের যে ডাক্তার গোপির পা ভালো করিয়া দিয়াছে সে কি মালার পা-খানার কিছু করিতে পারে না? একবার গিয়া দেখাইয়া আসিলে হয় কিন্তু। কিছু যদি ডাক্তার না করিতে পারে নাই করিবে, মালার বড়ো সাধ একবার গিয়া দেখাইয়া আসে। কুবের কী বলে?
কুবের গম্ভীর হইয়া বলে, তর পায়ের কিছু হইবো না গোপির মা।
কেন? হইবে না কেন? মালা জিজ্ঞাসা করে। আহা, একবার দেখাইয়া আসিতে দোষ কী? ডাক্তার যদি বলে কিছু হইবে না, নিজের কানে শুনিয়া আসিয়া মালা নিশ্চিন্ত হইয়া থাকিবে। একবার লইয়া চলুক কুবের তাহাকে। একফোঁটা যদি মায়া থাকে তার জন্য কুবেরের বুকে, একবার সে তাকে লইয়া চলুক সদরের হাসপাতালে। কুবের কী বুঝিবে খোঁড়া পায়ের জন্য সারাজীবন কী দুঃখ মালা পুষিয়া রাখিয়াছে মনে।
না? লইয়া যাইবে না কুবের? আঁই গো কুবেরের পাষাণ প্রাণ! মালার চোখে জল আসে। বিনাইয়া বিনাইয়া সে বলিতে থাকে যে মেয়ের জন্য কুবের দশবার হাসপাতাল যাইতে আসিতে পারে, মালাকে একবার, শুধু একটিবার লইতে তাহার আপত্তি! হ, অনেক পাপ করিয়াছিল আর জন্মে মালা, এবার তাই এমন কপাল লইয়া জন্মিয়াছে। কোলের ছেলেটাকে মালা মাই ছাড়াইয়া নীচে ফেলিয়া দেয়, ঘুরিয়া বসিয়া দরজার খুঁটিতে ঠকঠক করিয়া মাথা ঠোকে আর কাঁদিতে কাঁদিতে আহ্বান কবে মরণকে—যে মরণ এমনই নির্দয় যে মালার মতো পোড়াকপালির দিকে ফিরিয়াও তাকায় না।
চুপ যা গোপির মা, চুপ যা!
কেন চুপ যাইবে? কুবেরের দরদ আছে নাকি মালার জন্য? সে তো কপিলার মতো ভঙ্গি করিয়া হাঁটিতে পারে না যে তাকে লইয়া কুবের আমিনবাড়ির হাসপাতালে যাইবে, হোটেলে রাত কাটাইয়া আসিবে পরমানন্দে!
কুবের বিবর্ণ হইয়া বলে, কিবা কথা কস গোপির মা? মাইরা ফেলুম কইলাম। তারপর সে সুর বদলাইয়া বলে, হাসপাতালে যাওনের লাইগা কাঁদনের কাম কী আঁই! যাইবার চাস নিয়া যামুনে। যা মুখে লয় কইয়া রাগাইস না গোপির মা!
মালা ফোঁসফোঁস করিতে করিতে বলে, নিবা? নিয্যস? নিবা?
নিমু।
কিন্তু মালাকে আমিনবাড়ি নিয়া যাওয়ার সময় কুবেরের হয় না। হোসেন মিয়ার কাজের এখন অন্ত নাই, অবিরত চালান আসিতেছে, চালান যাইতেছে, এ বছর সতেজে ব্যাবসা আরম্ভ করিয়াছে হোসেন। মাঝখানে আবার একবার নৌকা লইয়া নারিকেলের ও চোরাই আপিমের চালান আনিতে কুবেরকে সেই নোয়াখালির উপকূলে যাইতে হইল। এবার আপিম পৌঁছাইয়া দিল একটি স্টিমলঞ্চ, লঞ্চে এক সাহেব আসিয়াছিল, হোসেন মিয়াকে কী তার খাতির! আপিমের পুঁটুলি নিয়া নৌকা চালাইতে এবারও কুবেরের বুকের মধ্যে সমস্ত পথ একটা আতঙ্ক জাগিয়া রহিল। গতবার ফিরিয়া গিয়া হোসেন প্রত্যেক মাঝিকে দশটা করিয়া টাকা—বখশিশ দিয়াছিল— এবারও দিবে সন্দেহ নাই, কিন্তু টাকার কথা ভাবিয়া কুবেরের একবিন্দু আনন্দ হইল না।
গণেশ জিজ্ঞাসা করে, কী ভাব কুবিরদা? ঝিমাও ক্যান? মিয়া বাই আপিম দিছে নাকি?
কুবের বলে, চুপ যা বলদ!
গণেশ বলে, কুকীর মা রূপার পইছা চায় কুবিরদা। ভাবি কী, ইবার মিয়াবাই টাহা দিলি দিমু পইছা গড়াইয়া কুকীর মারে—গণেশের খুশি ধরে না, কুবেরের গায়ে ঠেলা দিয়া বলে, হোসেন মিয়ার নায় কাম নিয়া বড়ো কাম করছ কুবিরদা! টাহার মুখ দেখিলাম।
কুবের তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে সুদুর নদী বক্ষে চাহিয়া বলে, উটা কী রে গণশা? পুলিশের লন্চো নাকি?
হ।
কুবের শিহরিয়া বলে, কোন দিকে যায়?
আমাগো দিকে আহে দেহি কুবিরদা।
কুবের বিবর্ণ মুখে হোসেন মিয়ার কাছে যায়। ফিসফিস করিয়া বলে, পুলিশ লন্চো আহে মিয়াছাব।
হোসেন মৃদু মৃদু হাসে, বলে, বইঠা ধর গিয়া কুবির বাই। হোসেন মিয়া থাকতি কারে ডরাও? নদীর মধ্যি জাল ফেলাইয়া মাল উঠাইবো কোন হালার পুত?
হ? বিপদ ঘনাইয়া আসিলে আপিমের বান্ডিল নদীর জলে ফেলিয়া দিলেই চুকিয়া গেল? তাই হইবে বোধ হয়! সেই জনাই হয়তো হোসেন সর্বদা জলপথে আপিমের চালান নিয়া আসে, নতুবা নোয়াখালি হোক চট্টগ্রাম হোক রেলে স্টিমারে চাঁদপুর আসা ঢের সুবিধা। কুবেরের ভয় কিছু কমে। তবু, সুদূর পুলিশ লঞ্চের দিক হইতে দৃষ্টি সে ফিরাইতে পারে না। লঞ্চটি যখন ক্ৰমে ক্ৰমে কাছে আসিয়া পাশ দিয়া চলিয়া যায় কুবের শ্বাসরোধ করিয়া থাকে।
একদিন ভোরবেলা বাড়ি ফিরিয়া কুবের মালাকে দেখিতে পাইল না। গোপি বলিল, রাসুর সঙ্গে মালা আমিনাবাড়ির হাসপাতালে গিয়াছে।
কুবের রাগিয়া বলিল, কার নায?
বাবুগো নায়।
তিনদিন নদীর বুকে কাটাইয়া আসিয়াছে, মেজাজ গরম হইয়া ছিল কুবেরের। রাগে সে গুম খাইয়া রহিল। গোপি গড়গড় করিয়া ব্যাপারটা বিস্তারিত বলিয়া গেল। মালা কদিন হইতে রাসুকে তোষামোদ করিতেছিল, কাল মেজোবাবু মকদ্দমাব জন্য আমিনবাড়ি গিয়াছেন, সেই সুযোগে বাবুকে বলিয়া কহিয়া মালা ও রাসু সঙ্গে গিযাছে।
মেজোবাবু? মেজোবাবুব নৌকায় মালা আমিনবাড়ি গিয়াছে? মেয়ের দিকে কুবের কটমট করিয়া তাকায়। গোপিই যেন অপরাধিনী।
গোপি ভয়ে ভয়ে বলে, লখা লগে গেছে বাবা।
সারাদিন কুবের বাড়ি ছাড়িয়া নড়িল না। জীবনটা হঠাৎ তিতো হইয়া গিয়াছে কুবেরের কাছে। সমস্ত সকালবেলাটা সে রাগে আগুন হইয়া রহিল, নিধু মাঝি আলাপ করিতে আসিলে তাহাকে অকথ্য গালাগালি করিয়া ভাগাইযা দিল, বিনাদোষে মারিয়া চণ্ডীকে করিয়া দিল আধমরা। তারপর রাগ কমিয়া অপরাহ্নে আসিল বিষাদ। কেবলই মনে হইতে লাগিল কুবেরের, মালা প্রতিশোধ লইয়াছে। কপিলার সঙ্গে সে কিনা একদিন আমিনবাড়িতেই রাত কাটাইয়া আসিয়াছিল, মালা তাই মেজোবাবুর সঙ্গে সেই আমিনবাড়িতেই গিয়াছে, হাসপাতালে যাওয়ার সেই একই উপলক্ষের ছল করিয়া।