কী কঠিন কাজে হোসেন মিয়া যে আত্মনিয়োগ করিয়াছে, কী সীমাহীন যে তাহার ধৈর্য ও অধ্যবসায়, এবার কুবের তাহা ভালো করিয়া বুঝিতে পারে। এই নিচু, জলা ও জঙ্গলপূর্ণ মনুষ্যবাসের অযোগ্য দ্বীপ, ধান ছাড়া আর কোনো ফসল যে দ্বীপের লোনা মাটিতে জন্মে না, লাউ কুমড়াগুলি ফলে কুঁকড়ানো শশার মতো ছোটো ছোটো,—এখানে এই মুষ্টিমেয় নরনারীর বসতি স্থাপন করাও হোসেন মিয়া ছাড়া আর কারও দ্বারা সম্ভব হইত না। সন্দ্বীপ, হাতিয়া, ধনমানিক, রাবনাবাদ এইসব জনপূর্ণ দ্বীপের কথা কুবের শুনিয়াছে, ময়নাদ্বীপ যদি মানুষের বাসের যোগ্য হইত ওই সব দ্বীপের মতো কবে এখানে গড়িয়া উঠিত গ্রাম। এ কী কদর্য একটা দ্বীপ হোসেন বাছিয়া লইয়াছে?
হয়তো সস্তায় পাইয়াছিল বলিয়া। স্বাস্থ্যকর, উর্বর দ্বীপ কিনিয়া জমিদারি পত্তনের টাকা হোসেন কোথায় পাইত, ও রকম জনহীন দ্বীপই বা কোথায়।
দ্বীপ দেখিয়া আমিনুদ্দি ও বসুল বড়ো দমিয়া গিয়াছে। ফিরিয়া যাওয়ার কথাটাও তাদের মুখে শোনা গিয়াছে দু-একরাব। তবে হোসেনের সামনে তারা কিছু বলে নাই। বলা যায় না। কত উপকার যে হোসেন তাদের করিয়াছে তার হিসাব হয় না। আমিনুদ্দি অপরিশোধ্য আর্থিক ঋণেই শুধু আবদ্ধ নয়, হোসেন না দিলে এ জীবনে স্ত্রী কি আর তাহার জুটিত, নছিবনের মতো স্ত্রী? রসুলকে জেলের দুয়ার হইতে ছিনাইয়া নিয়া আসিয়াছে হোসেন, দেশে ফিরিলে জেলেই হয়তো তাহাকে ঢুকিতে হইবে। প্রতিদানে হোসেন আর কিছুই তাদের কাছে চায় না, তারা শুধু এখানে বাস করুক, স্বপ্ন সফল হোক হোসেনের। ইতিমধ্যে তাদের জন্য ঘর উঠিতে আরম্ভ হইয়াছে, দযা করিয়া ওই ঘরে তারা নীড় বাধিলে কৃতাৰ্থ হইয়া যাইবে হোসেন। জঙ্গল কাটিয়া যত জমি তারা চাষের উপযোগী করিতে পরিবে সব তাদের সম্পত্তি, খাজনা বা চাষের ফসল কিছুই হোসেন দাবি করিবে না। নিজেদের জীবিকা তাহারা যতদিন নিজেরাই অর্জন করিতে পরিবে না, জীবিকা পর্যন্ত জোগাইবে হোসেন। গৃহ ও নারী, অন্ন ও বস্ত্র, ভূমি ও স্বত্ব সবই তো পাইলে তুমি, এবার শুধু খাটিবে ও জন্ম দিলে সন্তানেব, এটুকু পরিবে না?
হোসেনের কাছে ফিরিয়া যাওয়াব কথা তাই কেহ মুখে আনিতে পারে না। ফিরিয়া যে যায়, সে যায় পালাইয়া, চুপিচুপি, চোরের মতো।
হোসেন তাদের ক্ষমা করে। দেখা হইলে রাসুর মতো হোসেন তাদের জঙ্গল সাফ করার মজুরি দেয়। জোর-জবরদস্তি হোসেনের নাই, অন্যায় সে কারও প্রতি করে না। শুধু তাকেই হোসেন শাস্তি দেয, ভীষণ ও মর্মান্তিক, যারা শত্ৰুতা করে হোসেনের, অকারণে ক্ষতি করিতে চায়, বিঘ্ন জন্মায় হোসেনের স্বপ্ন সফল হইবার পথে।
কদিন কুবের দ্বীপ দেখিয়া ও দ্বীপের মানুষগুলির সঙ্গে ভাব করিয়া কাটাইয়া দিল। খেতের ধান সব কাটা হইয়া গিয়াছে, কিছু সবিয়া, বুট ও মটর লাগানো হইয়াছে, মূলা, পালং, কপি প্রভৃতি শাকসবজি গত বছর বাঁচিয়া থাকিতে চাহে নাই, এ বছর কয়েক বিঘা জমিতে নূতন একপ্রকার সার দিয়া পবীক্ষাব জন্য কিছু কিছু চাষ হইয়াছে কী হইবে বলা যায় না।
আরও ভিতরের দিকে দ্বীপের মাটি রবিশস্যের উপযোগী কিনা দেখিবার জন্য জঙ্গলের মধ্যে এখন অল্প একটু স্থান পরিষ্কার করা হইতেছে। সকালবেলা দা কুড়াল লইযা একদল লোক জঙ্গলের মধ্যে মাইলথানেক হাঁটিয়া যায়, নির্বাচিত স্থানটিতে গাছপালা ঝোপঝাড় কাটিয়া সাফ কবে, শাবল দিয়া খুঁড়িয়া গাছের শিকড় তুলিয়া ফেলে, তারপর সারাদিন মশা ও পোকার কামড়ে শরীর ফুলাইযা সন্ধ্যার সময় ফিরিয়া আসে। কুবের একদিন দেখিতে গিযা শিহরিয়া ফিরিয়া আসিল। এই দ্বীপটির সৃষ্টির দিন হইতে যে বনভূমি কুমারী, তার বুকের এক খাবলা মাংস যেন সকলে ছিনাইয়া লইযাছে, চারিপাশে নিবিড় বনের মাঝখানে পরিষ্কৃত স্থানটুকু এমনই বীভৎস দেখায়!
কয়েকদিন আগে কী একটা গোলমাল হহয়ছিল দ্বীপে, হোসেন উপস্থিত না থাকিলে অনেকে একত্র হইয়া জটলা করে, ভাসা ভাসা দুটো একটা কথা কানে আসে কুবেরের। বিপিন নামে ষাট বছরের এক বৃদ্ধকে হোসেন এখানে মোড়ল করিয়াছে, তাকে ঘিরিয়াই জটলাটা জমাট বাঁধে বেশি, কুবের কাছে গেলেই কিন্তু সকলে চুপ করিয়া যায়। তারপর একদিন সন্ধ্যার সময় কাজকর্ম শেষ করিয়া সকলে যখন ঘরে ফিরিয়াছে, নিজের স্বতন্ত্র কুটিরের দাওয়ায় বসিয়া হোসেন প্রসন্ন মুখে টানিতেছে তামাক, বিপিন কথাটা ফাঁস করিল। বলিল, নালিশ আছে একটা। নালিশ? হোসেনের মুখ গম্ভীর হইয়া গেল।
বিপিন ধীরে ধীরে ব্যাপারটা খুলিয়া বলিল। নারীসংক্রান্ত লজ্জাকর ঘটনা। এনায়েত দ্বীপে আসিয়াছে মাত্র ছমাস আগে, ইতিমধ্যেই সে সকলকে বড়ো জ্বালাতন করিয়া তুলিয়াছে। প্রথম প্রথম এর সঙ্গে ওর সঙ্গে প্রায়ই তার কলহ বাধিত, একদিন নিরীহ দুর্বল গগন ঘোষকে মারিয়া সে জখম করিয়া দেয়, সকলে মিলিয়া তখন খুব শাসন করিয়া দেয় এনায়েতকে। তারপর হইতে সে বেশ শান্তশিষ্ট হইয়াই থাকে, ব্যাপারটা তাই হোসেনকে জানানো হয় নাই। কিন্তু কদিন আগে সে এক ভয়ানক অপরাধ করিয়া বসিয়াছে। বসির মিয়ার বউটি ছেলেমানুষ, কিছুদিন হইতে এনায়েত তাকে নাকি বিরক্ত করিতেছিল, ভয়ে বউটি কাহাকেও কিছু বলে নাই। তারপর একদিন দুপুরবেলা সকলে যখন কাজে গিয়াছে, এনায়েত বসিরের ঘরে প্রবেশ করে। বসিরের স্ত্রীর চেঁচামেচি শুনিয়া পাশের কুটিরের আকবরের স্ত্রী গিয়া পড়ায় বেচারি সেদিন ভালোয় ভালোয় রক্ষা পাইয়াছে।