কুবের তো জানিত না যে তিন টাকায় দুআনার বেশি ফাঁকি দিবাব সাহস তাহার নাই বলিয়াই হোসেন তাহাকে বিশ্বাস করে! পাঁচটা টাকা কুবের কোনোদিন চুরি করিতে পরিবে না। শুধু সাহসের অভাবে নয়, দুআনার বেলায় যে বিবেক তাহার চুপ করিয়া থাকে পাঁচ টাকার বেলায় তাহাই গর্জন করিয়া উঠিবে।
টাকাগুলি কোমরে বাঁধিয়া কুবের লখা ও চণ্ডীর দিকে চাহিল। তারপর দুটা পয়সা সে ছুড়িয়া দিল ছেলেদের দিকে। পয়সা দুটা কুড়াইয়া নিয়া দুজনে চোখের পলকে অদৃশ্য হইয়া গেল।
এমন সময়ে দেখা গেল আলুথালু বেশে একটি মেয়ে ঘাটের দিকে ছুটিয়া আসিতেছে। নৌকার উপর আমিনুদ্দি চঞ্চল হইয়া উঠিল। হোসেন বলিল, নাও খোলো কুবির।
খোঁটা হইতে নৌকার দড়ি খুলিয়া শম্ভু হাতে ধরিয়া রাখিয়ছিল, সে লাফাইয়া নৌকায় উঠিয়া পড়িল। আমিনুদ্দির মেয়ে যখন ঘাটে একেবারে জলের কিনারা পর্যন্ত আসিয়া দাঁড়াইয়া পড়িল, নৌকা তফাতে সরিয়া গিয়াছে। বাপজান, বাপজান বলিয়া আকুল হইয়া মেযেটা কঁদিতে লাগিল, নদীতে বুঝি সে ঝাঁপই দিয়া বসে। উলুপী ছাড়া ঘাটে স্ত্রীলোক নাই যে ওকে ধরিবে। উলুপী কলসি কাখে জল নিতে আসিয়াছে, আমিনুদ্দির মেয়েকে তাহার ছুঁইবার উপায নাই। কিন্তু এখন সে কথা ভাবিবার সময় নয়। সে-ই মেয়েটাকে জড়াইয়া ধরিয়া রাথিল। আমিনুদ্দি হাঁকিয়া হাঁকিয়া মেয়েকে, বলিতে লাগিল, সে ফিরিয়া আসিবে, দুদিন পরে নিশ্চয় ফিরিয়া আসিবে।
মৃদু মৃদু বাতাস বহিতেছিল। শম্ভু ও বগা বাদাম তুলিয়া দিল। তারপর কেতুপুবের ঘাট দূর হইতে দূরে সরিয়া অদৃশ্য হইয়া গেল। কুবের আমিনুদ্দির কাছে আসিয়া বলিল, মাইয়ারে কইয়া আস নাই?
আমিনুদ্দি মাথা নাড়িল।
দাঁড় বাহিবার প্রয়োজন ছিল না, আস্তে আস্তে বাতাসের জোর বাড়িয়াছে, বাদাম উঠিয়াছে ফুলিয়া। কুবের এবার নিশ্চিন্ত হইয়া বসিয়া নিজের রাজ্যপাট ও প্রজাপুঞ্জের দিকে চাহিয়া দেখিতে লাগিল। রাজ্য প্রকাণ্ড, বসিবার শুইবার স্থানাভাব নাই, শুধু প্রজারা বড়ো অসুখী। মাঝবয়সি রমণীটি, পরিচয় নিয়া কুবের জানিতে পারিল রসুলের সে বোন, যাত্রার আগেই মৃদুস্বরে কঁদিতে আরম্ভ করিয়াছিল, কত গ্রাম তাহারা পার হইয়া আসিয়াছে, এখনও থাকিয়া থাকিয়া সে চোখ মুছিতেছে।
বেলা বাড়িতে লাগিল। কুবের সকলকে জলখাবার বণ্টন করিয়া দিল। বাড়ি হইতে বাহির হইবার সময় মনটা খারাপ হইয়াছিল, এখন মন্দ লাগিতেছে না কুবেরের। নদীকে সে বড়ো ভালোবাসে, নদীর বুকে ভাসিযা চলার মতো সুখ আর নাই। একে একে কতকগুলি লঞ্চ ও স্টিমার দুদিক হইতে ঢেউ তুলিয়া আসিয়া আগাইয়া যায়, সম্মুখের বোঝাই নৌকাগুলি পড়ে পিছনে। কোথাও নদীর একটি ছাড়া তটরেখা নাই, কোথাও অপর তীরের গাছপালা অস্পষ্ট চোখে পড়ে। কাউয়াচিলা পাখিগুলি ক্ৰমাগত জলে ঝাঁপাইয়া পড়িতেছে, বকেরা এখন একক শিকারী, সন্ধ্যায় ঝাঁক বাঁধিবে। স্টিমার, নৌকা, ভাসমান কচুরিপানা, আকাশের পাখি ও মেঘ সব ভাসিয়া চলিয়াছে–তীরের দিকে চাহিয়া মনে হয় জলের সীমায় মাটির তীরভূমিও বুঝি লঘু গতিতে চলিয়াছে পিছনে।
তবু নদী ছাড়া সবই বাহুল্য। আকাশের রঙিন মেঘ ও ভাসমান পাখি, ভাঙন-ধরা তীরে শুভ্র কাশ ও শ্যামল তরু, নদীর বুকে জীবনের সঞ্চালন, এ সব কিছুই যদি না থাকে, শুধু এই বিশাল একাভিমুখী জলস্রোতকে পদ্মার মাঝি ভালোবাসিবে সারাজীবন। মানবী প্রিয়ার যৌবন চলিয়া যায়, পদ্মা তো চিরযৌবনা। বৈচিত্র্য? কী তার প্রয়োজন? নূতন পৃথিবী কে খোঁজে, কে চায় পদ্মার রূপের পরিবর্তন, শুধু ভাসিয়া চলার অতিরিক্ত মোহ?
সকালবেলা সুবাতাস ছিল, তারপর বাতাস দিক পরিবর্তন করিল। বিশেষ কিছু অসুবিধা তাহাতে হইল না। দাঁড় টানিতে কোনো কষ্ট নাই। নদীর স্রোতই নৌকা ঠেলিয়া নিয়া চলিয়াছে, ফিরিবার সময় উজান ঠেলিয়া আসিতে প্রাণ বাহির হইয়া যাইবে বটে, এখন আরামের অন্ত নাই। মধ্যাহ্নে নৌকা ভিড়াইয়া রান্নার আযোজন করা হইল। দুটি উনান খুঁড়িয়া দুইটি হাঁড়িতে চাপানো হইল ভাত, কাছের এক গ্রামে তরিতরকারি মিলিল নিজেদের জন্য রাধিবার ভারটা কুবেরের উপরেই পড়িযাছিল, অদূরে রন্ধনরতা রসুলের বোন নছিবনকে দেখিতে দেখিতে কুবের মনে মনে একটু আপশোশ করিল। ভাবিল, কী ক্ষতি মুসলমানের রান্না খাইলে? ডাঙার গ্রামে যাহারা মাটি ছানিয়া জীবিকা অর্জন করে তাহাদের মধ্যে ধর্মের পার্থক্য থাক, পদ্মানদীর মাঝিরা সকলে একধর্মী। গণেশ, শম্ভু ও বগা সঙ্গে না থাকিলে কুবের তো নিজের জন্যে রাঁধিতে বসিত না।
খাওয়া-দাওয়ার পর আবার নৌকা চলিল। রাত্ৰি নটা দশটার সময় একেবারে নদীর কিনারায় সুষুপ্ত একখানি গ্রামের পাশে সেদিনকার মতো স্থগিত করা হয় যাত্রা।
তৃতীয় দিন অপরাহ্লে পাওযা গেল পদ্মা ও মেঘনার সঙ্গম। নদী এখানে সাগরের মতোই পারাপারহীন। সন্ধ্যার দেরি নাই দেখিয়া কুবের সেদিন নৌকা বাঁধিল, এদিকে সে আগেও আসিয়াছে বটে, কিন্তু নদী ভালো করিয়া চেনা নয়, সন্ধ্যাব পর নৌকা চালাইতে সে সাহস করিল না।
পরদিন চাঁদপুরে নৌকা ভিড়িল।
ভালোয় ভালোয এতখানি পথ আসিয়া কুবেবের মনে আনন্দ ধরে না। এবার হোসেন মিয়া আসিয়া পড়িলেই সে সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত হইতে পারে। জাহাজঘাটে স্টিমার ভিড়িলে কুবের গিয়া যাত্রীদের অবরোহণ পথটির মুখে দাঁড়াইযা থাকে, মোটঘাট লইয়া দেশবিদেশের কত নরনারী তাহার সামনে দিয়া রেল স্টেশনের দিকে চলিয়া যায়, কুবেবের উৎসুক দৃষ্টি অনুসন্ধান করে হোসেনকে। সমস্ত যাত্রী নামিয়া আসিবার পরেও সে অনেকক্ষণ দাঁড়াইয়া থাকে।