কুবের বলিল, দূর দূর লক্ষ্মীছাড়া! কুচরিত্তির হইছস, আঁই? ক্যান গেছিলি?
গণেশ প্রতিবাদ করিয়া বলিল, কুচরিত্তির কিবা? গীত শোননে দোষ নাই।
ঠিক বেড়ার আড়ালে মালা বুঝি শুনিতেছিল, ডাকিয়া বলিল, আবার কও গীতখান—শুনছ মাঝি? আবার কও।
কুবের ধমক দিয়া বলিল, চুপ থাক, গীত শুইনা কাম নাই।
খানিক পরে চাঁদপুর যাত্রার কথা উঠিল। আড়াল ছাড়িয়া হাতের ভরে ঘষিয়া ঘষিযা মালা এবার আসিল কাছে। মুসলমান পবিবারটিকে হোসেন মিয়া কোথায লইয়া যাইবে অনুমান করিতে কারও বাকি থাকে নাই, কে জানে কোন গ্রাম হইতে ওদের হোসেন সংগ্ৰহ করিয়া আনিয়াছে! কেহ কুপরামর্শ দিবে ভাবিয়া নৌকা হইতে ওদের সে গ্রামে নামিতে পর্যন্ত দেয় নাই। মানুষটি সহজ নয় হোসেন মিয়া! মরুক, তাদের কী? তারা মাঝি, পয়সা দিয়া যে লগি ঠেলিতে বলিবে তারই হুকুম মানিয়া নৌকা ভাসাইবে পদ্মায়, মানুষ না মাল কী আছে নৌকায় তাদের ভাবিবার প্রয়োজন নাই!
বিকালের দিকে গণেশের খোঁজে উলুপী আসিল, বলিল, যুগল আসিয়াছে। কী খবর যুগলের? সাতদিন পরে তাহার বিবাহ। চার কুড়ি টাকা পণ দিয়া সোনাখালির এক রূপসি কন্যাকে সে ঘরে আনিতেছে। ভালো কথা। আনুক! কুবেরের কী? আশ্বিনের ঝড়ে সব আশা-ভরসা তাহার উড়িয়া গিয়াছে। চার কুড়ি টাকা! চার কুড়ি টাকার ভাগ্যই যদি তার থাকিবে, পরের নৌকায় মাছ ধরিয়া লগি ঠেলিয়া সে মরিবে কেন আজীবন!
উলুপী আপশোশ করিয়া বলে, যে কপাল গোপির! একটা বছর সবুর সহিল না মেয়ের, ঠ্যাং ভাঙিয়া খোঁড়া হইয়া রহিল। কত পাপ করিয়াছিল আর জন্মে কে জানে!
কুবের বলিল, ক্যান, যুগাইলা বিনা মানুষ নাই দ্যাশে?
উলুপী একটা অদ্ভুত শব্দ করিয়া বলিল, কেডা নিব খোঁড়া মাইয়ারে?
কুবের ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে উলুপীর দিকে চাহিল, কিছু বলিল না।
রাত্রে সেদিন হঠাৎ আবার গোপির হাঁটু ব্যথা করিতে লাগিল। মেয়ে কী সহজে নিষ্কৃতি দিবে সকলকে। ওর যে কুক্ষণে জন্ম হইয়ছিল। ভোর ভোর কুবের যখন বাড়ির বাহির হইল, গোপি যাতনায় কাঁদিতেছে। বসিয়া থাকিবার উপায় কুবেরের ছিল না। বেলা হইলে তামাক পাতা নিয়া গোপির হাঁটুতে জড়াইয়া বাঁধিয়া দিতে বলিয়া, পথে গণেশকে হাঁক দিয়া, বিরস চিত্তে সে নদীতীরে গেল।
তখনও হোসেন ঘাটে আসে নাই। শম্ভু ও বগা সদা ঘুম হইতে উঠিয়া হাই তুলিতেছে। ছইয়ের মধ্যে মুসলমান পরিবারটি তেমনি জড়োসড়ো হইয়া বসিয়া আছে। রাত্রে কী ওরা ঘুমায় নাই? আগাগোড়া চাদর মুড়ি দিয়া আর একজন কে বসিয়া আছে নৌকায়, কাপড়ের পুটুলিটা রাখিতে নৌকায় উঠিয়া কুবের তাহাকে চিনিতে পারিল। আমিনুদ্দি।
আমাগো লগে যাইবা নাকি আমিনুদ্দি বাই? কুবের জিজ্ঞাসা করিল।
হ।
মাইয়া কান্দে না?
আমিনুদ্দি সায় দিল, হ। কান্দে।
দীর্ঘপথ পাড়ি দিতে হইবে, নৌকার দড়ি কাছি লগি ও দাঁড়গুলি কুবের পরীক্ষা করিয়া দেখিল, তক্তা তুলিয়া ভিতরে কতখানি জল উঠিয়াছে মাপিল। কিছু জ্বালানি কাঠ, তামাক ও নারিকেলের ছোবড়া, চাল, ডাল, তেল, লুন, পিতলের দুটা হাঁড়ি, দুটা লোহার কড়াই, কয়েকখানা কাঁসি কাল সংগ্ৰহ করিয়া রাখা হইয়াছিল, এ সমস্তের তদারকও কুবের করিল। কুবেবের দাযিত্ব কি কম। এত বড়ো অভিযানের সে পরিচালক!
তদারক শেষ করিয়া কুবের বসিয়া একটা বিড়ি ধরাইল, লক্ষ্য করিতে লাগিল ছইয়ের ভিতরের পবিবারটিকে। কী মনমরাই ওদের দেখাইতেছে সকালবেলার ম্লান আলোকে। কারও মুখে কথা নাই, কী যেন ভাবিতেছে সকলে, ভীত ও স্তব্ধ ছেলেমেয়েগুলির পর্যন্ত এতটুকু সাড়া নাই জীবনেব! গ্রাম ছাড়িয়া দেশ ছাড়িয়া নিরুদ্দেশ যাত্রার গভীর বিষাদ ওদের আচ্ছন্ন করিয়া দিয়াছে।
খানিক দেখিয়া কুবের পুরুষটিকে জিজ্ঞাসা করিল, নাম কী মিয়া?
সে মৃদুস্ববে বলিল, রসুল।
বাড়ি কই?
মালুর চর।
কথা বলিতে তাহার ভালো লাগিতেছে না বুঝিতে পারিয়া কুবে্র চুপ করিয়া গেল।
হোসেন মিয়া আসিতে আসিতে চারিদিক আলো হইয়া উঠিল। ততক্ষণে জেলেপাড়ার অনেকে ঘাটে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে উলুপী আসিয়াছে কলসি কাখে, স্বামীকে বিদায দিয়া সে কলসি ভরিয়া বাড়ি ফিরিবে। লখা ও চণ্ডী আসিয়াই কুবেরের কাছে একটা করিয়া পয়সা দাবি করিয়াছিল, না পাইয়া তাহারা মুখ গোঁজ করিয়া আছে, বিদায় নেওয়ার সময় বাপেব কাছে এতখানি নিষ্ঠুরতা তাহারা প্রত্যাশা করে নাই। রাসুও আসিয়া নৌকায় উঠিয়া বসিয়াছে। এমনিভাবে একদিন সকালবেলা সে ময়নাদ্বীপের উদ্দেশে রওনা হইয়াছিল। কিন্তু সে কথা রাসুর বুঝি আজ মনে নাই। নির্বিকার চিত্তে সে হোসেন মিয়ার নিকট বিড়ি চাহিয়া ধূমপান করে, যাচিযা কুবেরকে বারবাব শোনায় যে কুবেরের চিন্তার কারণ নাই, তাহার অনুপস্থিতির সময় সকলের দেখাশোনা সেই করিবে। কবে ফিরবা মাঝি? ঠিক নাই? তা হোক, রাসু যখন গ্রামে রহিল, বাড়ির জন্য কীসের ভাবনা কুবেরের?
এবার নৌকা খুলিলেই হয়। কুবেরকে পথখরচের জন্য টাকা দিয়া হোসেন নামিয়া গেল। টাকার পরিমাণটা কুবেরকে অবাক করিয়া দিল—কী দরাজ হাত হোসেন মিয়ার! ভয়ও কুবেরের হইল বইকী! এতগুলি টাকা সামলাইয়া রাখা, হিসাব করিয়া খরচ করা, সে বড়ো সহজ কর্মভোগ নয়। সবচেয়ে অস্বস্তির কথা, টাকাটা হাতে আসিবা মাত্র তাহার ভাবিতে ইচ্ছা হইতেছে তিন টাকায় যদি দুআনা বাঁচানো যায় নিজের জন্য, চেষ্টা করিলে এতগুলি টাকা হইতে না জানি কত বাঁচানো চলে! কাল হইতে এই কথাই সে থাকিয়া থাকিয়া ভাবিতেছিল বটে, ভাবিতেছিল কত টাকা হোসেন এবার তাহার হাতে দিবে,—পথখরচের টাকাটা অন্য কারও জিন্মায় হোসেন এবার দিবে কিনা এ আশঙ্কাও তাহার ছিল না এমন নয়। আজ টাকাটা পাইয়া সে খানিকক্ষণ অভিভূত হইয়া রহিল। এতখানি বিশ্বাস হোসেন তাহাকে করে? হোসেন মিয়াব মতো মানুষকেও ফাঁকি দিতে পারিয়াছে ভাবিয়া একটু গর্বও কুবেবের হয়, না লোকটা সৰ্বশক্তিমান নয।