শম্ভু বলিল, হোসেন মিয়া শুনব ক্যান? বলিয়া শম্ভু হাসিল। দাঁড় উঁচু করিয়া রাখিয়া বুক চিতাইয়া বলিল, ডরাও নাকি হোসেন মিয়ারে কুবির, আঁই?
কুবেরের পরিচয় এতক্ষণে ওরা পাইয়া গিয়াছে, সর্দার বলিয়া আর মানিবে না, বন্ধুর মতো সমানভাবে কথা কহিবে। কুবের বড়ো বিমর্ষ হইয়া যায়। কত বড়ো পদটা হোসেন মিয়া তাহাকে দিয়া গিয়াছে, ইতিমধ্যে সে তার পদমর্যাদা হারাইয়া বসিল! প্রথম প্রথম ওরা যখন খাতির করিয়া ভাব জমাইবার চেষ্টা করিয়াছিল তখন একটু দূরত্ব বজায় রাখিয়া চলিলে ভালো হইত। গণেশটা পর্যন্ত ওদের সঙ্গে মিলিয়া তার সঙ্গে ইয়ার্কি জুড়িয়া দিয়াছে।
কড়া কথা বলিবে নাকি? ভয় দেখাইবে? ওরা অবশ্য চটিয়া যাইবে, কিন্তু তাহাতে কী আসিয়া যায় তার! স্বয়ং হোসেন মিয়ার সে নির্বাচিত প্রতিনিধি! তবু জোর করিয়া কুবের কিছু বলিতে পারে না। যেটুকু সে বলে সকলে হাসিয়া উড়াইয়া দেয়, নৌকা অগ্রসর হয় মন্থরগতিতে।
আমিনবাড়ি পৌঁছিতে বিকাল হইয়া গেল। গিরিধারী সাহার দোকানো খবর দেওয়া হইল বটে কিন্তু সেদিন মাল খালাস করিতে কেহ আসিল না। রাত্রে হোটেলে খাইয়া কুবের নৌকায় শুইয়া রহিল, শম্ভু ও বগাব সঙ্গে শহরে গিয়া গণেশ যে কোথায রাত কাটাইয়া আসিল, সকালবেলা বারবার জিজ্ঞাসা করিয়াও কিছু জানা গেল না, রহস্য করিয়া তিনজনে তাহারা হাসিতে লাগিল। মনে মনে বড়ো রাগিয়া গেল কুবের। এ কী তামাশা জুডিয়াছে গণেশ তার সঙ্গে? আজীবন যে নির্ভরশীল বোকা লোকটা তাহার তোষামোদ করিয়া আসিয়াছে, সঙ্গদোষে একদিনে সে এমনভাবে বিগড়াইয়া গেল। একটু বেলায় দোকানের লোক আসিয়া মাল লইয়া গেল। কুবের অবিলম্বে নৌকা ছাড়িল। কেতুপুরের কাছাকাছি আসিয়া দূর হইতে দেখিতে পাওযা গেল, ঘাটে হোসেন মিয়ার সবচেযে বড়ো নৌকাটি বাঁধা রহিয়াছে। দেখিয়া কুবেরের মুখ শুকাইয়া গেল। এত দেরী করার জন্য না জানি হোসেন মিতা তাহাকে কী বলিবে। শম্ভু এবং বগাও হঠাৎ অত্যন্ত বাধ্য ও কর্মঠ হইয়া গেল, ঘাটের কাছে আসিয়া দাঁড় পড়িতে লাগিল ঋপাঝপ, গতি বাড়িয়া গেল নৌকার।
হোসেন মিয়া নৌকার সামনে বসিয়া তামাক টানিতেছিল, ছইয়ের মধ্যে জড়োসড়ো হইয়া বসিয়াছিল একটি নগ্নদেহ বছর চল্লিশ বয়সের পুরুষ, দুটি মাঝবয়সি রমণী ও তিনটি ছোটো ছোটো ছেলেমেযে। দেখিয়া মনে হয় একটি মুসলমান পরিবার। কুবের ওদের চিনিতে পারিল না। হোসেন মিয়ার আত্মীয়স্বজন যে নয় সহজেই টের পাওয়া যায় ময়লা ছেঁড়া কাপড় ওদের পরনে, শীর্ণদেহে শুষ্ক মুখে দাবিদ্র্যের সুপরিচিত ছাপ।
ভয়ে ভয়ে কুবের হোসেন মিয়াব মুখের দিকে তাকায, কিন্তু হোসেন মিয়া এতটুকু বিরক্তির লক্ষণ দেখায় না, দাডিতে হাত বুলাইয়া একবার শুধু জিজ্ঞাসা কবে, মাল খালাস দিছ?
কুবের রসিদটা তার হাতে দেয। তারপর এক টাকা দশ আনা পয়সা ফিরাইয়া দিয়া বলে যে রাহাখরচ বাবদ এক টাকা ছ আনা লাগিয়াছে। বলিয়া তাড়াতাড়ি হিসাবও দাখিল করিতে আরম্ভ করে। বেশি নয়, তিনটি টাকা হইতে দুআনা পয়সা মোটে সে চুরি করিয়াছে, তবু বুকের মধ্যে তাহার ঢিপঢিপ করিতে থাকে। হোসেন মৃদু মৃদু হাসে বলে, বও মিয়া, বও, হিসাব দিবানে পরে।
সেদিন ছুটি।
পরদিন আবার পাড়ি দিতে হইবে। এবার কাছাকাছি কোথাও নয, একেবারে সেই চাঁদপুর ছাড়া। মেঘনার মোহনার দিকে। গন্তব্য স্থানটি ঠিক কোথায হোসেন ভাঙিয়া বলিল না। কুবেবের প্রশ্নে মৃদু মৃদু হাসিয়া জবাব দিল, ব্যস্ততা কীসের? চাঁদপুর গিয়া কুবের নোঙর ফেলুক, ঠিক সময সেখানে হাজির হইয়া হোসেন স্বয়ং নৌকার ভার নিবে, বলিয়া দিবে কোন পথে চলিবে নৌকা, কোথায় গিযা শেষ হইবে যাত্রা।
এবার মাল নয, মানুষ যাত্রী। হোসেনের নৌকায় যে মুসলমান পবিবাবটি আসিয়াছে, তারা। কুবের ও গণেশ কতদিনে বাড়ি ফিরিতে পারিবে বলা যায় না। বাড়িতে খরচ দিয়া যাওযার জন্য হোসেন দুজনকে পাঁচটি করিয়া টাকা দিল।
বাড়ির পথে গণেশের সঙ্গে কুবের কথা বলিল না। রাগে সে চটিযাছে গণেশের উপর। গণেশ সঙ্গে সঙ্গে চলে, একথা সেকথা বলে, কুবের নীরব হইয়া থাকে, মুখ ফিরাইয়া চাহিয়াও দ্যাখে না। গণেশের কিনা মোটাবুদ্ধি, কুবের যে রাগিয়াছে এটা সে টের পাইল একেবারে বাড়ির কাছাকাছি গিয়া।
টের পাইবামাত্র সে বিবর্ণ হইয়া বলিল, গোসা করছ নাকি কুবিরদা?
কুবের বলিল, যা যা বাড়িত যা, বাজে বকস ক্যান?
বলিয়া সে হনহন করিয়া আগাইয়া গেল। গণেশ ক্ষুধার তাড়নায তখনকার মতো বাড়ি গেল বটে, ভাতটি খাইয়াই স আবার হাজির হইল কুবেরের বাড়িতে। কুবের কথা কয না, চাহিয়াও দ্যাখে না। গণেশ ভাবিয়া চিন্তিয়া তামাক সাজিয়া নিজে দুটো একটা টান দিয়াই কুবেরের দিকে বাড়াইয়া দিল, বলিল, ধর কুবিরদা।
কুবের হুঁকা গ্রহণ করিল। তবু সে কথা বলিল না!
বিপদে পড়িয়া গণেশ প্রায় কাঁদো কাঁদো হইয়া বলিল, কিবা কর কুবিরদা, আঁই? যামু গিয়া কইলাম, আর আমু না!
তখন তাহাকে ক্ষমা করিয়া কুবের জিজ্ঞাসা করিল, কাইল রাইতে ছিলি কই?
প্রশ্ন শুনিয়াই গণেশ হাসিয়া ফেলিল, ফিসফিস করিয়া বলিল, বাক্যা মাইয়া কুবিরদা, কিবা গীত কয়!
বলিয়া সে গুনগুন করিয়া গান ধরিল—
পিরিত কইরা জ্বইলা মলাম সই, আ লো সই!
আওন যাওন সমান সোনার, জউলা চুকা দই!
আ লো সই।
থাকলি ঘরে ছ্যাচন কেমন, টেঁকির তলে চিড়া যেমন,
বিদেশ গেলি মনের পোড়ন ভাইজা করে খই!
আ লো সই!