কুবের গিয়া চালার নীচে বসিয়া খাইয়া আসে। চালার বাহিরে সকলের দিকে পিছন ফিবিয়া বসিয়া খোলা আকাশের নীচে খায় কপিলা। তারপর এক পয়সার পান কিনিয়া আনে কুবের, ঘেরা স্থানটুকুর মধ্যে বসিয়া দুজনে নীরবে পান চিবায়। সারাদিন কত হাঙ্গামা কত হাঁটাহাঁটি গিয়াছে, দুপুরে স্নান হয় নাই, পেটে ভাত পড়ে নাই, ক্ৰমে ক্ৰমে দুজনেরই ঢুল আসিতে থাকে। আর একটু রাত হইলে কুবের উঁকি দিয়া দ্যাখে কাপড় মুড়ি দিয়া কেহ কেহ পাটিতে শুইয়া পড়িয়ছে, কোনো পাটিতে বসিয়া কেহ টানিতেছে তামাক।
কুবের উঠিয়া দাঁড়ায়, বলে, শো কপিলা।
তুমি কই যাও?
উই পাটিতে শুই গিযা আমি, যামু কই?
ক্ষীণ ভীরু কণ্ঠে কপিলা বলে, না, যাইও না মাঝি।
কুবের কি রাগিয়া যায়? কড়া সুরে জিজ্ঞাসা করে, কী করুম তবে?
ডরামু মাঝি।
কী আর করিবে কুবের, আবার সে পাটিতে বসে। কপিলা তাহার চাদরখানা পুঁটুলি করিয়া তাহাকে বালিশ করিয়া দেয়। তার নিজের মাথায় দেওয়ার জন্য ছোটো একটি পিঁড়ি আছে। কুবের শুইয়া পড়িলে এতক্ষণে কপিলা চুল খুলিয়া দেয়, আঙুল দিয়া চুল আঁচড়াইতে আঁচড়াইতে বলে, গোপির লাইগা পেরানডা পোড়ায় মাঝি, স্যায় বুঝি ডরাইয়া কাইন্দা মরে।
বুঝিতে পারা যায় কপিলা কাঁদিতেছে।
কেডা জানে কবে মাইয়া সাইরা উঠা বাড়িত্ যাইব। মাইয়ারে ফেইলা ক্যামনে ফিরুম মাঝি কাইল?
কুবের কাঠ হইয়া পড়িয়া থাকে। এখানে কাঁদিতেছে কপিলা, ওখানে মালাও হয়তো কাঁদিতেছে এখন। পথের দিকে চাহিয়া কত কী হয়তো ভাবিতেছে মালা। আর গোপি কী করিতেছে তা যেন ভাবাও যায় না।
পরদিন ভোরে আগে ঘুম ভাঙিল কপিলার। হাই তুলিয়া সে উঠিয়া বসিল, ঠেলা দিয়া কুবেরকে তুলিয়া দিল। বেড়ার বাহিরে পাটিতে এখনও রাত্রির অতিথিরা নাক ডাকাইতেছে, শুধু বাহিরের দুয়ারের কাছে কেরোসিন কাঠের বাক্সে বসিয়া তামাক টানিতেছে হোটেলের মালিক। রান্নাঘরে দাসী উনানের ছাই তুলিতেছে। কপিলাকে দেখিয়া ঘুমন্ত কুকুরটা উঠিয়া দাঁড়াইয়া লেজ নাড়িতে লাগিল।
মৃদু মধুর শীত পড়িয়াছে। কুবেরের চাদরখানা পরিযা কপিলা প্রথমে নদীতে ডুব দিয়া আসিল, তারপর স্নান করিতে গেল কুবের। কুবের ফিরিয়া আসা পর্যন্ত কপিলা ঘেরা স্থানটুকুর মধ্যে লুকাইয়া রহিল। পুরুষের দৃষ্টিপাতে আজ বড়ো লজ্জা করতেছে কপিলার, দিনের আলোয় আজ তার মনে হইতেছে জগৎসুদ্ধ সকলেই বুঝি জানে যার পাশে শুইয়া সে রাত কাটাইয়াছে সে তাহার স্বামী নয়। মুড়ি আর বাতাসা কিনিয়া কুবের ফিবিয়া আসিল। দুমুঠা খাইয়া কপিলা বলিল, আর সে খাইবে না। না থাক, কুবেরের পেটে জায়গা আছে ঢের। ধীরে ধীরে মুড়ি আর বাতাসা শেষ করিয়া সে বলিল, ল যাই হাসপাতাল।
তখন সবে রোদ উঠিয়াছে। এত সকালে গোপির সঙ্গে তাহারা দেখা করিতে পারিল না। নটা পর্যন্ত হাসপাতালের সামনে বসিয়া থাকিতে হইল। তারপর ঘণ্টাখানেক গোপির কাছে থাকিয়া, তাহাকে অনেক আশ্বাস ও সান্ত্বনা দিয়া ঘাটে ফিরিয়া আসিল। জহরেব শালা নুরুলের নৌকা কাঠের বোঝা নামাইয়া দেবীগঞ্জ ফিরিয়া যাইতেছিল, সেই নৌকায় তাহারা উঠিয়া বসিল।
গ্রামের ঘাটে নামিয়া কুবের বলিল, বাড়িত্ যা কপিলা, আমি গণেশের লগে দেখা কইরা যাই। বাড়িতে যদি ঝড়ঝাপটা ক্ৰন্দন ঘনাইযা থাকে প্রথম ধাক্কাটা কপিলার উপর দিয়াই যাক। কপিলা কিন্তু এক বাড়ি যাইতে রাজি হইল না, রুখিযা বলিল, আরে পুরুষ!
তখন আর কথাটি না বলিয়া কুবের হনহন করিয়া বাড়ির দিকে চলিতে আরম্ভ করিল। কপিলা পিছাইযা পড়িল। পথে যার সঙ্গে দেখা হইল সেই সগ্রহে গোপির সংবাদ জিজ্ঞাসা করিল, চাপা হাসি ঢাকা পরিহাস রূঢ় ইঙ্গিত কিছুই কারও কাছে জুটিল না কুবেবেব। এত কী সুনাম সে বাথিয়া গিযছিল গ্রামে যে কপিলার সঙ্গে একটা পুবা রাত্রি অজানা স্থানে অতিবাহিত করিয়া আসিয়াও সে সুনাম নিটোল অক্ষত দেখিতে পাইতেছে? ব্যাপারখানা কী? চলিতে চলিতে হঠাৎ কুবেরের মনে পড়ে, দুজন তো নয়, গোপিকে ধরিলে তারা যে তিনজন। গ্রামে লোক তাকে আর কপিলাকে হোটেলের চাঁচের বেড়ার নির্জনতায় পৃথকভাবে কল্পনা করে নাই, ওদের সঙ্গে গোপিকেও একত্র চিন্তা করিয়াছে। কারও মনে তাই সন্দেহ জাগিবার অবকাশ থাকে নাই।
কুবের দাঁড়াইল। কপিলা কাছে আসিলে বলিল, দ্যাখ কপিলা, জিগাইলে কইস রাইতে হাসপাতালে ছিলাম, গোপির কাছে।
কপিলা মাথা নাড়িয়া বলিল, দুর অ! মিছা কথা আমি কই না মাঝি!
বলিয়া খানিক আগে কুবের যেমন করি্য়াছিল তেমনি হনহন করিয়া কপিলা আগাইয়া গেল। কে জানে কী আছে কপিলার মনে! বারণ না মানিয়া কাল ও আমিনবাড়িতে থাকিয়া গেল, আজ বারণ না মানিয়া সত্য কথা বলিতে চায়! বলুক! পুরুষ মানুষ কুবের কী ভয তার? কপিলার সত্যবাদিতার ফল যদি কেহ ভোগে, ভুগিবে কপিলাই!
বাড়ি গিয়া কুবের দেখিল, মালার কাছে কপিলা সবিস্তারে আমিনবাড়ির কাহিনি বলিতেছে। কাছে চাটাইটার উপর সে বসিয়া পড়িল। মালাকে সবই বলিবে নাকি কপিলা, হোটেলে রাত্রিযাপনের কথা পর্যন্ত? কপিলা বলিয়া যায়—সন্ধ্যাবেলায় কী বিপদেই তারা পড়িল। হাসপাতালে থাকিতে দিল না, ফিরিবার নৌকা পাওয়া গেল না, কোথায় যায়? শেষে এক মোক্তারবাবু দয়া করিয়া তাদের আশ্রয় দিলেন।—কী নাম যান মাঝি মুক্তারবাবুর? মুখ ফিরাইয়া কপিলা জিজ্ঞাসা করিল কুবেরকে।
কুবের থতোমতো খাইয়া বলিল, কেডা জানে?