নৌকা চলিয়া গেল!
কুবের মুখ ফিরাইযা দেখিল, নদীর বাতাস কপিলাকে স্পষ্ট করিয়াছে, শাড়িখানি মিশিয়া গিয়াছে অঙ্গে। বেগুনি রঙের শাড়িখানি পরিয়াই সে যে আজও পথে বাহির হইয়াছে, এতক্ষণ কুবের তো তাহা লক্ষ করে নাই! এতক্ষণে খেযাল করিয়া সে যেন কেমন অসন্তোষ বোধ করিল। কপিলাকে লইয়া এখন সে কী করিবে, যাইবে কোথায়? কী মতলব করিয়াছে কপিলা? থাকিবার ওর কী প্রয়োজন ছিল?
কী দ্যাখ মাঝি? কী ভাব? কপিলা বলিল।
জিগানে কাম কী তর? কুবের বলিল।
গোসা কর ক্যান? উই দ্যাখ জাহাজ আহে।
সেইখানে নদীতীরে দাঁড়াইয়া তাহারা চাহিয়া থাকে, চক্রাকারে পাক দিয়া জাহাজ আসিয়া ভিড়ে জেটিতে। কী ভিড় হইয়াছে আজ জাহাজে! আজ পূজা শেষ, আজও দেশ-দেশান্তরের মানুষ গৃহে ফিরিতেছে। আর, কী অদৃষ্ট কুবেরের, মেয়েটাকে আজ এই বিদেশে হাসপাতালে ফেলিয়া রাখিয়া মূঢ়ের মতো সে দাঁড়াইয়া আছে নদীতীরে, কোথায় যাইবে কী করিবে ঠিক নাই! ভো দিয়া জাহাজ ছাড়িয়া যায়। নদীর আলোড়িত জল ঢেউ তুলিযা তীরে আছড়াইয়া পড়ে। মেযেটার জন্য এমনই ঢেউ উঠিয়াছে কুবেরের বুকে।
হঠাৎ কপিলা বলিল, মাঝি, পয়সা কড়ি আনছ?
হ।
কত?
তা দিয়া কী কাম তর?
আমি কিছু আনছি, লাগলে নিয়ো।
কপিলা আঁচলে গেরো বাঁধা পয়সা দেখাইল।
কুবের হাঁ না কিছুই বলিল না। জেটি নির্জন হইয়াছে দেখিয়া খানিক পরে জেটিতে গিয়া ছায়ায় তাহারা বসিয়া রহিল। কুবের তাকায় না কপিলার দিকে, একটার পর একটা বিড়ি ধরাইয়া টানিতে থাকে–মিনিটে মিনিটে বিড়ি খাওয়ার মতোই সে যেন বড়োলোক।
ক্যামনে ফিরবা মাঝি? খানিক পরে কপিলা জিজ্ঞাসা করিল।
কেডা জানে। যেমন কাণ্ড তর কপিলা! তরে নিয়া কী যে করুম—
আমার লাইগা ভাইবো না মাঝি।
এতক্ষণে কী মনে করিয়া কুবের হাসিল, বড়ো পোলাপান তুই কপিলা। সোয়ামি শুইনা কী কইব তর ভাবছস নি?
কউক!
তা বইকী! কলঙ্ক কিনিবার সাধ যে কপিলার ষোলো আনা দেখা যায়? কুবের গম্ভীরভাবে মাথা নাড়ে। এ তো ভালো কথা নয়। এক বাড়িতে যারা বাস করে শুধু দুর্নাম কিনিবার জন্য এখানে তাদের পড়িয়া থাকিবাব কোনো মানে হয় না। শুধু গোপির জন্যই কি কপিলা রহিয়া গেল? গোপিকে সে এত ভালোবাসে? কে জানে, কপিলার মন বুঝিবাব ক্ষমতা ভগবান কুবেরকে দেন নাই।
বেলা পড়িয়া আসিলে দুজনে হাসপাতালে গেল। কুবেরের এবাব প্রথম মনে হইল থাকিয়া বুঝি ভালো করিয়াছে কপিলা। এমন করিয়া নতুবা গোপিকে সে নিজে তো সান্ত্বনা দিতে পারিত না কপিলার মতো! তা ছাড়া যে কাণ্ড আজ ডাক্তার করিলেন গোপিকে লইযা, কপিলা না থাকিলে বুক বাঁধিয়া সে সময় কে থাকিত গোপির কাছে? গোপির হাঁটুর হাড়ই শুধু ভাঙে নাই, মস্ত একটা বাঁশের গোজ ঢুকিয়া গিযাছিল মাংসের মধ্যে, পা ফুলিযা সেটাকে আড়াল করিয়া ফেলিযাছে। ডাক্তার এ বেলা সেটা টানিযা বাহির করিলেন, তারপর ভাঙা হাড়টা যতদূর সম্ভব স্বস্থানে বসাইয়া কোমরের কাছ হইতে পা পর্যন্ত কাঠের তক্তা বসাইয়া বাঁধিয়া দিলেন ব্যান্ডেজ। কুবের এ সব দেখিল না, বাহিরে বসিয়া সে শুধু গোপির আর্তনাদ শুনিল।
দুজনে যখন তাহারা হাসপাতাল হইতে পথে নামিয়া আসিল, সন্ধ্যা হইতে বেশি বাকি নাই। দূরে বিসর্জনের বাজনা বাজিতেছিল। গ্রামেই এখন তাহদের ফিরিতে হইবে। এখানে রাত কাটাইবে কোথায়? কাল আবার কুবের আসিয়া গোপিকে দেখিয়া যাইবে। নদীর ঘাটে গিয়া কুবের নৌকায় নৌকায় চেনা মাঝি খুঁজিযা বেড়াইল। চেনা মাঝি দু-চারজন মিলিল বটে কিন্তু আজ বিজয়ার সন্ধ্যায নৌকা তো কেহ খুলিবে না! দেবীগঞ্জের দিকে যাদের যাওয়ার দরকার ছিল দিনে দিনে তারা চলিয়া গিয়াছে! তবে গহনার নৌকা* ছাড়িবে একটা, কুবের ইচ্ছা করিলে ভাড়া দিয়া যাইতে পাবে। নতুবা কাল সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করুক যে নৌকাই কেতুপুবের দিকে যাক, কুবের তাহাতে গ্রামে ফিরিতে পবিবে।
কত নাও যাইব কাইল, পয়সা দিয়া ক্যান যাইবা কুবের বাই? বলিয়া পরিচিত মাঝি কুবেরকে নৌকায় রাত্রিযাপন করিতে অনুরোধ কবে। শুধু পরিচিত মাঝি কেন, পদ্মানদীর মাঝি সে, পদ্মানদীর যে-কোনো মাঝির নৌকায় রাত্রিযাপনের অধিকার তার জন্মগত, কিন্তু এখানে রাত কাটানোই যে মুশকিল। কপিলার সঙ্গে একত্র এখানে রাত কাটাইয়া গিযা কাল গ্রামে সে মুখ দেখাইবে কী করিয়া? কী বিপদেই কপিলা তাহাকে ফেলিয়াছে!
পয়সা দিয়া গহনার নৌকায় যাওয়া ছাড়া উপায় নাই! কত ভাড়া লইবে কে জানে! জিজ্ঞাসা করিতে গহনার নৌকার মাঝি বলে, সোনাখালি হইয়া তীরে তীরে দেবীগঞ্জ পৌঁছাইয়া পদ্মা পার হইয়া কুবেরকে কেতুপুরে তাহারা নামাইয়া দিতে পরিবে না। হাসাইলের খাল পর্যন্ত তাহারা এ তীর ঘেঁষিয়া চলিবে, কুবের সেখানে নামিতে পারে, ভাড়া মাথা পিছু তিন আনা।
হাসাইলের খাল হইতে কেতুপুর দু ক্লোশের কম নয়। এই রাত্রে অতখানি পথ কপিলা হাঁটিতে পরিবে কিনা সন্দেহ। কুবের জিজ্ঞাসা করে, কী করি কপিলা?
কপিলা বলে, না গেলাম আইজ? কাইল বিয়ানে গোপিরে দেইখা মেলা করুম?
থাকুম কই? নায়?
তাই কি হয়। ডাকাত না গুন্ডা নৌকার মাঝি কে জানে, কপিলা কী পারে এই নদীর ঘাটে খোলা নৌকায় শুইয়া থাকিতে? ওই তো ঘাটের হোটেল দেখা যায়, ওখানে একটা ঘরভাড়া নেওয়া যাক।
কী আর করিবে কুবের, দরদস্তুব করিয়া ছ আনায় বড়ো একটা ঘরের একদিকে ছাঁচের বেড়ায় ঘেরা স্থানটুকু ভাড়া করে। দরজা বা ঝাপ কিছুই নাই, টুকিবার জন্য একটু ফাঁক রাখিযা ঘেরিয়া দিয়াছে। ঘরের মধ্যে সারি সারি মোটা পাটি পাতা, অতিথিরা রাত্রে শয়ন করিবে–ঘেরা স্থানটুকুর মধ্যে একখানা পাটিতেই মেঝের প্রায় সবটা ভরিয়া গিয়াছে। বাহিরে খোলা চালার নীচে খাওয়ার জায়গা, রান্নাঘরেও কতকগুলি পিঁড়ি পড়ে, চালাটার মাঝখানে একটা কালি-পড়া লণ্ঠন রাখা হইয়াছে, বাকি সর্বত্র জ্বলিতেছে কেরোসিনের কুপি।