একটা চওড়া কাঠের তক্তায় শোয়ইয়া ধরাধরি করিয়া গোপিকে নদীতীরে লইয়া যাওয়া হইল। কাঁথা বালিশ হাতে করিয়া কপিলা গেল সঙ্গে। ইতিমধ্যে জেলেপাড়ায় খবর রটিয়া গিয়াছিল। গ্রামের একটি মেয়েকে হাসপাতালে নেওয়া প্রতিমা বিসর্জনের চেয়ে কম গুরুতর ব্যাপার নয় জেলেপাড়াবাসীদের কাছে—এই ভোরে নদীতীরে একটি ছোটোখাটো ভিড় জমিয়া গিয়াছিল।
কপিলা আগে নৌকায় উঠিয়া কাঁথাপত্র বিছাইয়া দিল, তারপর গোপিকে তুলিয়া শোয়ানো হইল। যন্ত্রণায় ও ভয়ে গোপির মুখখানা ফ্যাকাশে হইয়া গিয়াছে। হাসপাতাল? না জানি কী ভয়ংকর সেই স্থান! কে জানে সেখানে কী হইবে তাহার। কপিলার একটা হাত গোপি সবলে আঁকড়াইয়া ধরিয়া রহিল।
নৌকা খোলা হইবে এমন সময় দেখা গেল রাসু ছুটিয়া আসিতেছে। নদীতীরে পৌঁছিয়া সে লাফাইয়া নৌকায় উঠিয়া পড়িল।
কুবের জিজ্ঞাসা করিল, কী রে রাসু? রাসু হাফাইতে হাফাইতে বলিল, আমিও যামু।
চলুক! এতবড়ো নৌকা, স্থানাভাব হইবে না। বেশি লোক সঙ্গে থাকিলে গোপিকে উঠানো নামানোর বরং সুবিধাই হইবে।
মহকুমা শহর আমিনবাড়ি, সেইখানে সরকারি হাসপাতাল। কেতুপুর হইতে আমিনবাড়ি বেশি দূর নয়, ঘণ্টা তিনেক লাগিল পৌঁছিতে। রাসুব সাধ ছিল গোপিকে ঘাট হইতে হাসপাতাল পর্যন্ত লইয়া যাইতে সেও কাঁধ দিবে কিন্তু তার প্রয়োজন হইল না। সবাইকে নৌকায় বসিয়া থাকিতে বলিয়া যুগল নামিয়া গেল, খানিক পরে কোথা হইতে খুঁজিয়া পাতিয়া নিয়া আসিল একটা পালকি। যুগল কি কম পাকা লোক! পালকি চাপিয়া গোপি হাসপাতালে গেল।
হাসপাতালে তখন রোগীর ভিড় জমিয়াছে। একটা ছোটো ছেলের ফোড়া অপারেশন করা হইতেছিল, কী তাহার তীব্র চিৎকার। গোপি তো দেখিয়া শুনিযা বিবর্ণ হইয়া গোঙাইতে আরম্ভ করিল। কুবেবের মুখখানাও শুকাইয়া পাংশু হইয়া গিয়াছে। সকলেই অল্পবিস্তর ভীত ও সস্তুস্ত। শুধু অবিচলিত আছে রাসু। ময়নাদ্বীপ হইতে পলাইয়া আসিয়া নোয়াখালির হাসপাতালে সে পনেরোটা দিন কাটাইযা দিয়াছিল, এ তাহার পরিচিত স্থান। সকলকে সে অভয় দিয়া বলিতে লাগিল, ভয় নাই, ভয় নাই, সব ঠিক হইয়া যাইবে!
সেই গিয়া ডাক্তারকে গোপির অবস্থা বলিয়া নামধাম লিখাইযা আসিল। কী গর্ব রাসুর! দেখুক কুবের, কেমন চটপটে পাকা লোক সে! দেখিয়া রাখুক!
বেলা প্রায় এগারোটার সময় অবসর করিয়া ডাক্তারবাবু গোপির পা পরীক্ষা কবিলেন। পরীক্ষা করিয়া রাগের সীমা রহিল না ডাক্তারের। রাসুই কিনা বুক ঠুকিয়া কথা বলিতেছিল, তাহাকেই গোপির অভিভাবক ঠাওরাইয়া ধমক দিয়া ডাক্তার আর কিছু রাখিলেন না। এতকাল কী করিতেছিল তাহারা, বসিয়া বসিয়া ঘাস কাটিতেছিল? আগে আনিতে পারে নাই গোপিকে? পা যদি এবার কাটিয়া বাদ দিতে হয়?
অপারেশন টেবিলে শুইয়া গোপি কপিলার হাত শক্ত করিয়া ধরিয়াছিল, গোঙাইয়া গোঙাইয়া সে তো কঁদিতে থাকেই কপিলাও মৃদু সুর তোলে কান্নার—তারপর ডাক্তারের ধমকে আচমকা স্তব্ধ হইয়া যায়। পরীক্ষা শেষ করিয়া ডাক্তার বড়ো ভয়ানক কথা বলিলেন। এখানে রাখিয়া যাইতে হইবে গোপিকে। তবে এ কথাও তিনি বলিলেন যে, রাখা না-রাখা গোপির বাপের খুশি, জোর জবরদস্তি নাই।
সে আর কথা বলিল না—হয়তো এতক্ষণে গোপির অবস্থার গুরুত্ব বুঝিয়া মন ও তার খারাপ হইয়া গিয়া থাকিতে পারে। ঘরের মধ্যে গোপি কঁদিতে লাগিল—আগো মাসি আমি থাকুম না, আমারে নিয়া যাও—আর বাহিরে কুবের গণেশ আর যুগল গম্ভীর মুখে বলাবলি করিতে লাগিল যে এবার কী করা কর্তব্য। পরামর্শ করা একান্ত মিছে, ডাক্তার যে কথা বলিয়াছে তারপর গোপিকে না রাখিলে চলিবে না এখানে, তবু তারা অজ্ঞ ও ভীরু গ্রামবাসী কিনা, দীর্ঘ পরামর্শ ছাড়া কোনো সিদ্ধান্তই তারা করিতে পারে না।
গোপিকে মেয়ে ওয়ার্ডে ভর্তি করিয়া দেওয়া হইল। তারপর আর তাহাদের গোপির কাছে থাকিবার উপায় রহিল না। আবার সেই চারটার সময় আসিয়া মেয়েটার সঙ্গে তাহারা দেখা করিতে পারিবে।
গোপি কপিলাকে কিছুতে ছাড়িবে না। কাঁদিয়া কাঁদিয়া সে বলিতে লাগিল, আগে মাসি নিয়া যাও, কই থুইয়া যাও আমারে?
হাঁটিতে হাঁটিতে তাহারা ফিরিয়া গেল নদীর ঘাটে। পথে কিনিয়া লইল কিছু চিড়ামুড়ি। এত বেলা অবধি কেহ তাহারা কিছু খায় নাই।
নীরবে সকলে জলযোগ শেষ করিল। এবার? কী করিবে তাহারা এবার?
যুগলের থাকিবার উপায় নাই। নৌকা তাহার ভাড়া হইয়া আছে, সকালবেলাই তাহার দেবীগঞ্জে যাওয়ার কথা ছিল। কুবের এখন গ্রামে ফিরিবে তো? গ্রামের ঘাটে সকলকে নামাইয়া দিয়া যুগল সোজা চলিয়া যাইবে দেবীগঞ্জে।
কুবের বলিল, তোমরা যাও, বৈকালে মাইয়াটারে একরার না দেইখা আমি যামু না।
রাসু বলিল, আমিও থাকি, আঁই?
কুবের বলিল, না রাসু, যা গিয়া তুই। কই থাকুম কী বিত্তান্ত ঠিক নাই, তুই থাইকা করবি কী?
গণেশ থাকিতে চাহিল, কুবের তাকেও বুঝাইয়া নিবৃত্ত করিল। কপিলা অবশ্যই ফিবিয়া যাইবে তাই তার থাকা না থাকার কথাই উঠিল না, কপিলাও কিছু বলিল না। কিন্তু কপিলাই শেষ পর্যন্ত নৌকায় উঠিল না। সেও বিকাল পর্যন্ত এখানে থাকিবে, গোপিকে আর একরার না দেখিয়া গ্রামে কি সে ফিরিতে পারে? আহা, মাসি মাসি বলিয়া মেযেটা হয়তো কাঁদিয়া মরিতেছে। কেহ তাহাকে টলাইতে পারিল না। কুবের কত বলিল, নিজে সে কোথায় থাকিবে ঠিক নাই, মেয়েমানুষ সঙ্গে থাকিলে কত হাঙ্গামা কত অসুবিধা—তা ছাড়া লোকে বলিবে কী? কপিলা কোনো কথাই কানে তুলিল না।