কেতুপুরে চারদিন পূজার ঢাক-ঢোল বাজিল,–উৎসব হইল। জেলেপাড়ার ছেলেবুড়া দুবেলা ঠাকুর দেখিল, কেহ কেহ তাড়ি গিলিয়া খুব মাতলামি করিল, শীতল একদিন একটা দেশি মদের বোতল সাবাড় করিয়া রাসুকে ধরিয়া আচ্ছা করিয়া পিটাইয়া দিল। রাসুর উপর তাহার এত রাগ কেন কে জানে
লখার সঙ্গে কপিলা একদিন সন্ধ্যার সময় ঠাকুর দেখিতে গিয়াছে, খানিক পরে কুবেরও গুটি গুটি গিয়া হাজির। গিয়া দ্যাখে শীতলেব সঙ্গে হাসিয়া হাসিয়া কথা বলিতেছে কপিলা। বাবুদের কর্মচারী শীতল, পূজাও বাবুদেরই,–ভাবখানা দ্যাখ শীতলের, সেই যেন সর্বেসর্বা এখানে। ওর সঙ্গে হাসিয়া হাসিয়া এত কথা কীসের কপিলার? তারপর শীতল প্রসাদ চাহিয়া আনিয়া কপিলার আঁচলে বাঁধিয়া দেয়, কপিলা একগাল হাসে। এত লোকের মধ্যে কপিলার এই নির্লজ্জ আচরণে রাগে কুবেরের নিশ্বাস বন্ধ হইয়া আসে। সে ডাকিয়া বলে, লখা। ল বাড়িত্ যাই।
কপিলা বলে, মাঝি আইছ নাকি? খাড়াও মাঝি, আমি যামু, মারে পেন্নাম কইবা লই।
কুবের বলে, লখ্যা, আইলি রে হারামজাদা পোলা?
কপিলা প্রণাম শেষ করিতে করিতে লখাকে সঙ্গে করিয়া কুবের জোরে জোরে হাঁটিতে আবম্ভ করিল। একটু পথ গিয়াই গতি তাহার হইয়া আসিল মন্থর। না, কপিলার জন্য ফিরিয়া সে যাইবে না, তবে আস্তে আস্তে হাঁটিতে দোষ নাই। কপিলা আসিয়া সঙ্গ নেয় তো নিক। অন্ধকার হইয়া গিয়াছে। কপিলাকে একা ফেলিয়া যাওয়া ঠিক কর্তব্য হইবে না। হয়তো শীতলকেই সে বাড়ি পৌঁছাইয়া দিতে বলিবে! এতখানি অন্ধকার রাস্তা শীতলের সঙ্গে হাঁটিয়া চলিবে কপিলা? তার চেয়ে বিড়ি কিনিবার ছলে এখানে কুবেরের একটু দাঁড়ানোই ভালো।
বিড়ি কিনিতে কিনিতে কপিলা আসিয়া পড়িল। কুবের কথাটি বলিল না। তিনজনে নীরবে চলিতে লাগিল বাড়ির দিকে। কপিলা আড়চোখে কুবেরের মুখের দিকে তাকায়, কিছু ঠাহর হয না অন্ধকারে। চলিতে চলিতে দেখা হয় রাসুর সঙ্গে, যুগীকে লইয়া সে ঠাকুর দেখিতে যাইতেছে।
কপিলা যুগীকে বলে, বইন, এক কাম করবা? আমাগো লখারে লইয়া যাও।
কুবের আপত্তি করিয়া বলে, ক্যান, ঠাকুর দ্যাখে নাই লখা?
কপিলা বলিল, পোলাপান, সাধ নি মেটে দেইখা? তোমাব লখা বুড়া তো হয় নাই মাঝি, এক নজর দেইখা ফাল দিয়া বাড়িত্ ফিববো? যা রে লখা যুগী মাসির লগে,–দেইখো বইন, পোলারে, পোলা বড়ো বজ্জাত।
মতলব কী কপিলার? লখাকে সরাইয়া দিল কেন? কিছুই যেন বুঝিতে পারা যায় না। কপিলা নীরবে পথ চলে, কুবের মনে মনে রাগিতে থাকে। শেষে একটা তেঁতুলগাছের তলে পথের যেখানে দুৰ্ভেদ্য অন্ধকার রচিত হইয়াছে সেখানে হঠাৎ কুবের শক্ত করিয়া কপিলার আঁচল চাপিয়া ধরে, বলে, শীতলের লগে অত কথা কীসের তর, আঁই?
কপিলা বলে, কী কর মাঝি? খুইলা পড়ব যে পেরসাদ? আঁচলটা কপিলা টানিয়া ছাড়াইতে চেষ্টা করে, মিনতি করিয়া বলে, পোলাপানের লাখান কইরো না মাঝি, ছাড়— রাস্তার মদ্যি ইডা কেমনতর কাণ্ড জুড়লা?
বলিতে বলিতে আর কপিলা আঁচল টানাটানি করে না, কুবের তাহাকে জড়াইয়া ধরিলে শান্ত হইয়া থাকে, হঠাৎ বড়ো যেন করুণ কণ্ঠে বলে, মনডা ভাল না মাঝি, ছাড়বা না? মনডা কাতর বড়ো।
কুবের তাহাকে ছাড়িয়া দেয়।
চলিতে চলিতে জিজ্ঞাসা করে, মন কাতর ক্যান রে কপিলা?
কে জানিত কপিলা এমন উত্তর দিবে!
সোয়ামিরে মনে পড়ে মাঝি।
হ? আগাগোড়া সব তাহা হইলে ফাঁকি কপিলার, সব ছল, এতক্ষণ রসিকতা করিতেছিল কুবেরের সঙ্গে! ভালো, কুবেরও রসিকতা জানে।
কপিলার গালটা সে টিপিয়া দেয়, হিহি করিয়া হাসে; বলে, তাই ক কপিলা, তাই ক! যে সোয়ামি দূর কইরা খেদাইয়া দিছে তার লাইগা মনডা পোড়ায় তর! গেলেই পারস সোয়ামির ঘর?
যামু।
বলিয়া কপিলা হনহন করিয়া হাঁটিতে আরম্ভ করে।
পদ্মা নদীর মাঝি – ৬
সেদিন রাত্রে গোপির পায়ের যন্ত্রণা খুব বাড়িয়া গেল। তাহাকে নূতন ঘরে আনা হইয়াছিল, সারারাত সে ছটফট করিয়া গোঙাইয়া কাটাইয়া দিল। মালা জাগিয়া বসিয়া রহিল তাহার শিয়রে। কুবেরও অনেক রাত অবধি জাগিয়া রহিল। তারপর সে ঘুমাইয়া পড়িল বটে কিন্তু ভালো ঘুম হইল না। শেষ রাত্রে উঠিয়া বসিয়া সে ডাকিল, গোপির মা?
জবাব দিল কপিলা–গোপির মা ঘুমায়।
কুবের উঠিয়া আসিয়া বলিল, যা তুই ঘুমা গা কপিলা, আমি বইয়া থাকি।
কপিলা চাপা গলায বলিল, আরে পুরুষ! রাত ভইরা ঘুমাইয়া বিয়ানে কয় যা তুই ঘুমা গা কপিলা। কাউয়ায় ডাক পাড়ে শুনছ মাঝি?
তাইতো বটে! ফরসা হইয়া আসিয়াছে যে!
ঝাঁপ খুলিয়া কুবের বহি্রে গেল। গণেশের বাড়ি গিয়া ডাকাডাকি করিয়া তুলিল গণেশকে। যুগল কাল বোনের বাড়ি নেমন্তন্ন খাইতে আসিয়া রাত্রে এখানেই ঘুমাইয়াছিল, সেও উঠিয়া আসিল। কুবের বলিল, গণেশ, মাইয়ারে তো হাসপাতালে নেওন লাগে, বড়ো কাতর মাইয়া রাইত ভইরা চেঁচাইয়া মরছে।
গণেশ বলিল, হ?—ব কুবির, তামুক খা। হাসপাতালে নেওন ত সহজ কথা না! কিবা নিবি ভাবছস নি?
নাও নিয়া যামু, আবার কিবা? সমস্যার সমাধানে গণেশ খুশি হইয়া বলিল, তবে চিন্তা নাই, যুগইলার নাওখান মিলব আইজ, নাও নিয়া আইছে যুগইলা।—নাওখনি দিবি না যুগইলা তর?
যুগল সাগ্রহে নৌকা দিতে সম্মত হইল। বলিল, সেও সঙ্গে যাইবে। খুব বুঝি ফুলিয়াছে গোপির পা-টা? কোথায় চোট লাগিয়াছে? আগে কেন মেয়েকে হাসপাতালে নেয় নাই কুবের–আগেই লইয়া যাওয়া উচিত ছিল। যাই হোক, আজ যদি হাসপাতালে লইতেই হয়, দেরি করিয়া লাভ কী? বেলা হইয়া গেলে হাসপাতালে ডাক্তারকে পাওয়া যাইবে না।