হ, কুবেরের ঘুম পাইয়াছে। উন্মুক্ত নদীতীরে বসিয়া সে কাটাইয়াছে ঝড়ের রাত্রি, সকালে হাঁটিয়া আসিয়াছে দেবীগঞ্জে, দুটি মুড়ি শুধু সে খাইয়াছে, বাড়ি পৌঁছানো পর্যন্ত দুর্ভাবনায় টিপচিপ করিয়াছে বুকের মধ্যে। এখন পেট ভরিয়া খাইয়া উঠিয়া আর তাহার জাগিয়া থাকিবার ক্ষমতা নাই। মালার সব কথা তার কানে যায় না। গোপির মাথার কাছে সংকীর্ণ স্থানটুকুতে কোনোমতে কাত হইয়া সে একসময় ঘুমাইয়া পড়ে।
সন্ধ্যার আগে জেলেপাড়ার সকলেই ফিরিয়া আসিল। পদ্মার গ্রাসে কেহ যায় নাই। পীতম মাঝির নৌকাটি শুধু মাঝ-নদীতে ঝড়ের মুখে পড়িয়া ডুবিয়া গিয়াছে। নৌকায় ছিল পীতমের ছেলে মাখন, কুবেরের প্রতিবেশী সিধু আব তার ভাই মুরারি,–অর্ধমৃত অবস্থায় একটা চরে উঠিয়া রাত কাটাইয়া তাহারা ফিরিয়া আসিয়াছে, আর বলিয়া বেড়াইতেছে তাহাদের বাহাদুরিব কাহিনি, পাহাড়-সমান ঢেউয়ের সঙ্গে লড়াই করিয়া কী ভাবে তাহারা নিজেদের প্রাণ বাঁচাইয়াছিল।
কয়েকটা দিন বড়ো গোলমালের মধ্যে কাটিয়া গেল। ধীরে ধীরে ভাঙা ঘরগুলির সংস্কারের চেষ্টা চলিতে লাগিল। কেতুপুরের দু-চারখানা ঘরবাড়ি পড়িয়া গিয়াছিল, একদিন মেজোকর্তা অনস্ত তালুকদারের সভাপতিত্বে গ্রামবাসীর এক সভা হইয়া গেল। ক্ষতিগ্রস্ত আর দুঃস্থদের জন্য চাঁদা তোলার ব্যবস্থা হইল। অনন্তবাবু নিজে দান করিলেন দশ টাকা, গ্রাম হইতে আরও পনেরো টাকা উঠিল। তার মধ্যে সাত টাকা দেওয়া হইল কেতুপুরের নন্দ ভট্টাচার্যকে, আহা, ব্রাহ্মণের দুখানা ঘর পড়িয়া গিয়াছে। জেলেপাড়ার জন্য দেওয়া হইল দশ টাকা, দুটাকা করিয়া পাঁচজনকে। বাকি টাকাটা বোধ হয় ফান্ডে জমা রহিল।
সুখের বিষয় দীর্ঘ অনুপস্থিতির পর এই সময় হোসেন মিয়া গ্রামে ফিরিয়া আসিল। ঘুরিয়া ঘুরিয়া সে চারিদিকের অবস্থা দেখিয়া বেড়াইল, তারপর দাড়ি নাড়িয়া বলিল, না, টাকা কর্জ দিমু না, ছন দিমু, বাঁশ দিমু, নিজে খাড়াইয়া তোমাগো ঘর তুইল্যা দিমু-শ্যাষে নিকাশ নিয়া খত লিখুম, একটা কইবা টিপ দিবা।
তাই সই।
পুরাতন জীর্ণ ঘরের বদলে যদি নূতন ঘর ওঠে, খত লিখিয়া দিতে আর আপত্তি কী? ঘর যাহাদের পড়িয়া গিয়াছিল সকলে তাহারা খুশি হইয়া উঠিল। যাহাদের ঘর পড়ে নাই তাহারা দুঃখিত হইয়া ভাবিল, ঘরদুয়ার তাহাদেরও পড়িয়া গেলে মন্দ হইত না!
সকলেই সাগ্রহে হোসেন মিয়ার সাহায্য গ্রহণ করিল, করিল না শুধু আমিনুদ্দি। সে মাথা নাড়িয়া বলিল, না মিয়া, ঘর দিয়া আমার কাম নাই।
আমগাছের তলে তাহার ঘরখানা যেমন নিষ্পেষিত হইয়া পড়িয়াছিল তেমনিভাবে পড়িয়া রহিল। সত্যিই তো, ঘর দিয়া আমিনুদ্দি কী করিবে? কে আছে আমিনুদ্দির? কার জন্য আবার সে দুঃখের, দারিদ্র্যের নীড় বাঁধিবে? জেলেপাড়ার সকলেই আবার পদ্মার বুকে নৌকা ভাসাইয়াছে, আমিনুদ্দি কোথাও যায় না, কার জন্য পদ্মার অতল জলে সে জীবিকার সন্ধান করিবে? শুধু মেযেটা আছে,—মমীন। কেন আছে কে জানে! সারাদিন মমীন মৃদুস্বরে কাঁদে, আমিনুদ্দি চাহিয়াও দ্যাখে না, না ডাকে কাছে, না বলে মেয়ের সঙ্গে কথা।
ক্ৰমে ক্ৰমে সকলের নূতন খুঁটি, নুতন বেড়া ও নূতন চালার ঘরগুলি সমাপ্ত হইল। হোসেন মিয়া মজুরদের কী ইঙ্গিত দিয়াছিল সেই জানে, কুবেরের ঘরটা উঠিল সকলের আগে। ঘর দেখিতে আসিয়া হোসেন মিয়া গোপির জন্য বড়ো দরদ দেখাইল। বলিল, হাসপাতালে নিয়া যাও কুবের বাই, জবর চোট পাইছে মালুম হয়।
তারপর একখানা খত বাহির করিয়া বলিল, টিপ সই দেও কুবের—- একুশ টাহা দশ আনার খত লিখিছি—বাদ দিছি দুই টাহা। টিপ সই দিয়া রাখ, যখন পারবা দিবা,–না দিলি মামলা করুম না বাই! –হোসেন মিয়া মৃদু মৃদু হাসিল, জান দিয়া তোমাগো দবদ কবি, খত কিসির? লিখা থুইলাম, হিসাব থাকবো—না-ত কিসির কাম খত দিয়া?
কুবের বলিল, পুরানো বাঁশ পুরানো বেড়া দিলি খরচা কম হইত মিয়া বাই।
ক্যান? পুরান বাঁশ দিয়া ক্যান? খরচার লাইগা ভাইবো না, খরচা তো দিছি আমি! না, দিই নাই?
হ, মিয়াবাই দিছেন, আপনেই দিছেন। টিপসই দিয়া কুবের হোসেনের মুখের দিকে চাহিল। বড়ো ভয় করে কুবের হোসেন মিয়াকে, বড়ো টান তাহার হোসেন মিয়ার দিকে। কী যাদুমন্ত্রে তাহাকে বশ করিয়াছে লোকটা?
গোপির পায়ের ব্যথাও কমে না, ফোলাও কমে না। মেয়েটাকে নিয়া মহা মুশকিলে পড়িয়াছে কুবের। মালার মতো গোপিও কি শেষ পর্যন্ত গোড়া হইয়া যাইবে? কী ব্যবস্থা করা দরকার কুবের বুঝিয়া উঠিতে পারে না। হোসেন মিয়ার কথামতো সদরের হাসপাতালে লইয়া যাইবে নাকি? সে তো কম হাঙ্গামার ব্যাপার নয়। অতখানি পথ গোপিকে কেমন করিয়া লইয়া যাইবে? ব্যথায় সে বিছানাতেই পাশ ফিবিতে পারে না, অত নাড়াচাড়া তাহার সহিবে কেন? অথচ পায়ের যা অবস্থা গোপির, শীঘ্রই কোনো ব্যবস্থা না করিলে নয়।
ইতিমধ্যে পূজা আসিয়া পড়িল। চরডাঙ্গা হইতে একদিন আবার আবির্ভাব ঘটিল অধরের। আবার সে রাগারগি করিয়া সকলকে লইয়া যাইতে চাহিল। ছেলেমেয়েগুলি তার সঙ্গে ফিরিয়া গেল চরডাঙ্গায়, কপিলা গেল না। বলিল, কেন, ঘর পড়িয়া গিয়া টেঁকি ঘরটাতে যখন তাহারা সকলে একসঙ্গে মাথা গুজিয়া ছিল, অসুবিধার অন্ত ছিল না, তখন অধর আসিতে পারে নাই? এখন নতুন ঘর উঠিয়াছে, থাকিবার কোনো অসুবিধা নাই এখন সে যাইবে কেন এদের এই বিপদের মধ্যে ফেলিয়া? কুবেরও ইহাতে সায় দিয়া বলিল, হ কেন যাইবে কপিলা তাদের এই বিপদের সময়? কপিলা সত্যই প্রাণ দিয়া সকলের সেবা করিতেছিল, বড়ো কৃতজ্ঞ হইয়া উঠিয়াছিল কুবের তাহার কাছে। বড়ো ভালো মেয়ে কপিলা। কেন যে ওর বোকা স্বামীটা ওকে ত্যাগ করিয়াছে!