ভীত বিবর্ণ মুখে কাঁপিতে কাঁপিতে জেলেপাড়ার নবনারী পদ্মাতীরে গিযা দাঁড়ায়, আরক্ত চোখে চাহিয়া থাকে উন্মত্ত জলরাশির দিকে। ঘাটে তিনটি নৌকা বাধা ছিল, একটি অদৃশ্য হইয়াছে, দুটি উঠিয়া আসিয়াছে ডাঙায়। খানিক দূরে গাছপালা সমেত খানিকটা ডাঙা ধসিয়া গিয়াছে, আরও খানিকটা অংশ ফাটল ধরিয়া আছে, শীঘ্রই ধসিবে।
পদ্মাতীরে দাঁড়াইয়া থাকিয়া কোনো লাভ নাই, চাহিয়া চাহিয়া চোখ ফাটিয়া গেলেও কাল যারা নদীতে পাড়ি দিয়াছিল তাদের দেখিতে পাওয়া যাইবে না। যে নদীতে ডুবিয়াছে সে তো গিয়াছেই, ডাঙায় যারা আশ্রয় পাইয়াছে পদ্মা শান্ত না হইলে তাদেরও ফিরিয়া আসা সম্ভব নয়।
ডাঙা পথে আসিতে পারে।
কিন্তু এখনও মাঠে ঘাটে জল একেবারে সরিয়া যায় নাই, কে কোথায় ডাঙা পাইয়াছে কে জানে, হয়তো সেখান হইতে ডাঙায় পায়ে হঁটিয়া আসিবার সুবিধা নাই। গৃহের জন্য মন হয়তো তাহাদের উতলা হইয়াছে, ভোরের আলো ফুটিলে এই উন্মাদিনী নদীর তীর ঘেঁষিয়া নৌকা বাহিয়া হয়তো তাহারা গ্রামে ফিরিবার চেষ্টা করিবে।
বেলা বাড়িয়া উঠিলে ধীরে ধীরে বাতাস পড়িয়া গেল। পদ্মা শান্ত হইয়া আসিল। অপরাহ্নে একটি দুটি করিয়া জেলেপাড়ার নৌকাগুলি ফিরিয়া আসিতে লাগিল। প্রথমে যারা আসিয়া পড়িল, সকলে তাদের ঘিরিয়া জুড়িলা দিল কলরব।—বাকি সব? অন্য সকলেব খবর কী? সকলের খবব তাহারা দিতে পারিল না, কে কোথায় তীরে ভিড়িয়াছে কে জানে, দু-চারজনের খবর মাত্র তাহারা বলিতে পারিল। যাদের সংবাদ জানা গেল তাদের উদবিগ্ন আত্মীয়স্বজনের মুখ হইতে একটা কালো পর্দা যেন সরিয়া গেল। খবর যাদের মিলিল না তাদের আপনজনেরা আবার নীরবে পদ্মার সীমাহীন বুকে দৃষ্টি পাতিয়া রাখিল। তবে প্রত্যেকটি নৌকাই এই একটি আশার বারতা বহিয়া আনিতে লাগিল যে কারও প্রাণহানি হইয়াছে এ সংবাদ তাহারা শুনিয়া আসে নাই। বুক বাঁধিয়া সকলেই প্রতীক্ষা করিতে পারে, হয়তো ব্যর্থ হইবে না।
আমিনুদ্দি ও নাসির একসঙ্গেই ফিবিয়া আসিল। আমিনুদ্দির জন্য কেহ ঘাটে আসে নাই। জহর আসিয়াছিল, নাসিবকে দেখিয়া সে শুধু বলিল, বাপজান, ফিরা আলি রে?–বলিয়া আমিনুদ্দির দিকে চাহিযা একেবারে চুপ করিয়া গেল। কারও মুখে কথা নাই। আমিনুদ্দিকে দেখিয়া সকলে স্তব্ধ হইয়া গিয়াছে।
আমিনুদ্দি এদিক ওদিক চাহিল, তারপর ভীত উৎসুক কষ্ঠে জহরকে জিজ্ঞাসা করিল, খপর কও মিয়াবাই, ভালা নি আছে বেবাকে? চুপ মাইরা রইলা কেরে, আঁই?
কারও কিছু বলিবাব ছিল না। হাত ধরিয়া জহর তাহাকে ধীরে ধীরে গ্রামের দিকে টানিয়া লইযা গেল।
তারপর আসিল কুবের ও গণেশ। আসিল তাহারা অনুকূলের নৌকায়, ধনঞ্জয়েব নৌকাটি ডুবিয়া গিয়াছে। বোকা গণেশের একটা পা মচকাইয়া গিয়াছিল, ঝড়ে নয়, পা পিছলাইয়া একটা সে আছাড় খাইয়াছিল ডাঙায়। উলুপী আজ সারাদিন একরকম পদ্মাতীরেই কাটাইয়াছে, গণেশকে ধরিযা সেই বাড়ি লইয়া গেল। কুবেরের জন্য কেহ আসে নাই। পরের মুখে সে তাহার গৃহের বৃত্তান্ত শুনিল। বড়ো ঘরটা পড়িয়া গিয়াছে? যে ঘর ছাইবার জন্য হোসেন মিয়া শণ দিয়াছিল? গোপির পায়ে চোট লাগিয়াছে? বিবর্ণ মুখে কুবের বাড়ির দিকে পা বাড়াইল। ঘর দুয়ার অনেকেরই পড়িয়াছে, সর্বনাশ হইয়া গিয়াছে আমিনুদ্দির, কিন্তু তাহার নিজের ঘরখানা পড়িয়া যাওয়ার চেয়ে বড়ো দুঃসংবাদ কুবেরের কাছে আর কিছুই নয়। কবে আবার সে ঘর তুলিতে পরিবে কে জানে। মাথা গুজিবে কোথায়?
পথে দেখা হইল কপিলার সঙ্গে। কুবেরকে দেখিয়াই কপিলা উচ্চরবে কাঁদিয়া উঠিল,—বড়ো উচ্ছাস কপিলার। বলিল, ফিরা আইছ মাঝি! মুখ রাখছেন—ঠাকুর আমার মুখ রাখছেন,–আমি না মানত কইরা থুইছি পাঁচ পহার হরিলুট দিমু!
কুবের বিব্রত হইয়া বলিল, কাঁদ ক্যান?
সঙ্গে চলিতে চলিতে কপিলা আত্মসংবরণ করিল।
পায় বিষম চোট পাইছে মাইয়া। শুনছ নি বিত্তান্ত?
কুবের মাথা হেলাইয়া বলিল, হ। ফুইলা গেছে না?
বিষম ফুলছে! দিনডা ভইরা চিল্লাইয়া মরছে মাইয়া।
চারিদিকে ভাঙা গাছ, ভাঙা ঘর, পত্রপল্লবে আচ্ছাদিত পথ, কুবেরের চোখে জল আসে। ঘরের কাছে গিয়া সে দাঁড়াইল। ঘর কই কুবেরের? ভাঙিয়া অঙ্গনে হুমড়ি খাইযা পড়িয়াছে। পিসিব ঘরে সকলে আশ্ৰয লইয়াছিল। ঘরে ঢুকিয়া কুবের টেঁকিটার উপর বসিয়া পড়িল। গোপি শুইয়া শুইয়া কাতরাইতেছে। পায়ে তাহার চুন হলুদ মাখানো হইয়াছে, হাঁটুর কাছে বেজায় ফুলিয়াছে। মালার চোখে ভীতিবিহুল দৃষ্টি। গতরাত্রের প্রলযংকর কাণ্ড ভীরু পঙ্গু নারীটিকে আধমরা করিয়া রাখিয়া গিয়াছিল, এখনও সে সামলাইয়া উঠিতে পারে নাই। কুবের আসিয়া পড়াতে সে যেন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলিয়া বাঁচিল।
পিসি ভাত রাধিয়া রাখিয়াছিল। ঝড়বাদল ভূমিকম্প কিছুই পিসির ভাত রাধা বন্ধ করিতে পারে না। খানিক পরে উঠিয়া কুবের ভাত খাইল। তারপর গোপির কাছে একটু বসিল। যন্ত্রণায় মেয়েটার মুখ নীল হইয়া গিযাছে। কী করিবে কুবের, যন্ত্রণা লাঘবের কী মন্ত্র সে জানে গোপিকে যাতে এতটুকু আরাম দিতে পাবে? নীরবে চাহিয়া দেখা ছাড়া কোনো উপায় নাই। মালা ধীরে ধীরে বলিতে থাকে মড়মড় করিয়া ঘর ভাঙিয়া পডাব সময় আতঙ্কে দিশেহারা হইয়া ছুটিয়া বাহিরে যাওযায় কী ভাবে গোপির উপব চালটা আসিয়া পড়িয়াছিল। ঘরে থাকিলে মেযেটার কিছু হইত না। ঝড়ের সময় যে বাহিরে যাইতে নাই, ঘরের মধ্যে থাকাই সবচেয়ে নিরাপদ, সেটুকু বৃদ্ধি তো মেয়ের নাই। শুনিতে শুনিতে কুবের ঢুলিতে থাকে।