মাঝরাত্রে একরার তারা খানিকক্ষণ বিশ্রাম করিয়াছে। রাত্রি শেষ হইয়া আসিলে কুবের বলিল, একটু জিরাই গো আজান খুড়া।
জিরানের লাইগা মরস্ ক্যান ক দেহি? বড়িত্ গিয়া সারাড়া দিন জিরাইস। আর দুই খেপ দিয়া ল।
কুবেব বলিল, উঁহুঁ তামুক বিনা গায়ে সাড় লাগে না। দেহখান জানগো আজান খুড়া, আইজ বিশেষ ভাল নাই।
জাল উঁচু করিয়া রাখিয়া কুবের ও গণেশ ছইয়ের সামনে বসিল। ছইয়েব গায়ে আটকানো ছোটো হুঁকাটি নামাইয়া টিনের কোটা হইতে কড়া দা-কাটা তামাক বাহির করিয়া দেড় বছর ধবিয়া ব্যবহুত পুরাতন কল্কিটিতে তামাক সাজিল কুবের। নারিকেল ছোবড়া গোল করিয়া পাকাইয়া ছাউনির আড়ালে একটিমাত্র দেশলাইযের কাঠি খরচ করিয়া সেটি ধরাইয়া ফেলিল। বারো বছর বয়স হইতে অভ্যাস করিয়া হাত একেবারে পাকিয়া গিয়াছে।
নৌকা স্রোতে ভাসিয়া চলিয়াছিল।
এক হাতে তীরের দিকে কোনাকুনি হাল ধরিয়া ধনঞ্জয় হাতটি বাড়াইয়া দিয়া বলিল, দে কুবের, আমারে দে, ধরাই।
কলিকাটি তাহার হাতে দিয়া কুবের রাগ করিয়া বসিয়া রহিল। কুবেরের পাশে বসিয়া গণেশ বাড়াবাড়ি রকমের কাঁপিতেছিল। এ যেন সত্যসত্যই শীতকাল। হঠাৎ সে বলিল, ইঃ আজ কী জাড় কুবির !
কথাটা কেহ কানে তুলিল না। কারও সাড়া না পাইয়া কুবেরের হাঁটুতে একটা খোঁচা দিয়া গণেশ আবার বলিল, জানস কুবির আইজকার জাড়ে কাঁইপা মরলাম।
এদের মধ্যে গণেশ একটু বোকা। মনের ক্রিয়াগুলি তার অত্যন্ত শ্লথ গতিতে সম্পন্ন হয়। সে কোনো কথা বলিলে লোকে যে তাহাকে অবহেলা করিয়াই কথাটা কানে তোলে না এটুকুও সে বুঝিতে পারে না। একটা কিছু জবাব না পাওয়া পর্যন্ত বারবার নিজের কথার পুনরাবৃত্তি করে। ধমকের মতো করিয়া যদি কেউ তার কথার জবাব দেয় তাতেও সে রাগ করে না। দুঃখও তাহার হয় কিনা সন্দেহ।
কুবেরের সে অত্যন্ত অনুগত। জীবনের ছোটোবড়ো সকল ব্যাপারে সে কুবেরের পরামর্শ লইয়া চলে। বিপদে আপদে ছুটিয়া আসে তাহারই কাছে। এক পক্ষের এই আনুগত্যের জন্য তাহাদের মধ্যে যে বন্ধুত্বটি স্থাপিত হইযাছে তাহাকে ঘনিষ্ঠই বলিতে হয়। দাবি আছে, প্রত্যাশা আছে, সুখদুঃখের ভাগাভাগি আছে, কলহ এবং পুনর্মিলনও আছে। কিন্তু গণেশ অত্যন্ত নিরীহ প্রকৃতির বলিযা ঝগড়া তাহাদের হয় খুব কম।
পুড়িয়া শেষ হওয়া অবধি তাহারা পালা করিয়া তামাক টানিল। নৌকা এখন অনেক দূর আগাইয়া আসিয়াছে। কলিকার ছাই জলে ঝাড়িয়া ফেলিয়া হুঁকাটি ছইয়ে টাঙাইয়া দিযা জাল নামাইয়া কুবের ও গণেশ বইঠা ধরিল।
গণেশ হঠাৎ মিনতি করিয়া বলিল, একখান গীত ক দেখি কুবির?
হ, গীত না তর মাথা।
কুবেরের ধমক খাইযা গণেশ খানিকক্ষণ চুপ করিযা বহিল। তারপর নিজেই ধরিয়া দিল গান। সে গাহিতে পারে না। কিন্তু তাহাতে কিছু আসিয়া যায় না। ধনঞ্জয় ও কুবের মন দিয গানের কথাগুলি শুনে। (যে যাহারে ভালোবাসে সে তাহারে পায় না কেন, গানে এই গভীর সমস্যার কথা আছে। বড়ো সহজ গান নয়।)
কুবের হাঁকিয়া বলে, যদু হে এ এ এ–মাছ কিবা?
খানিক দূরের নৌকা হইতে জবাব আসে, জবর।
জবাবেব পব সে নৌকা হইতে পালটা প্রশ্ন করা হয়। কুবের হাঁকিয়া জানায় তাদেরও মাছ পড়িতেছে জবর।
ধনঞ্জয় বলে, সাঁঝের দরটা জিগা দেখি কুবের।
কুবের হাঁকিয়া দাম জিজ্ঞাসা করে। সন্ধ্যা বেলা আজ পৌনে পাঁচ, পাঁচ এবং সওয়া পাঁচ টাকা দবে মাছ বিক্রি হইয়াছে। শুনিয়া ধনঞ্জয় বলে, কাইল চাইরে নামবো। হালার মাছ ধইরা যুত নাই।
কুবের কিছু বলে না। ঝপ কবিয়া জালটা জলে ফেলিয়া দেয়। শরীরটা আজ তাহার ভালো ছিল না। তার স্ত্রী মালা তাকে বাহির হইতে বারণ করিয়াছিল। কিন্তু শরীরেব দিকে তাকাইবার অবসর কুবেবের নাই। টাকার অভাবে অখিল সাহার পুকুবটা এবারও সে জমা লইতে পারে নাই। সারাটা বছর তাকে পদ্মার মাছের উপরেই নির্ভর করিয়া থাকিতে হইবে। এ নির্ভরও বিশেয জোরালো নয়, পদ্মার মাছ ধরিবার উপযুক্ত জাল তার নাই। ধনঞ্জয় অথবা নড়াইলের যদুর সঙ্গে সমস্ত বছর তাকে এমনি ভাবে দুআনা চারআনা ভাগে মজুরি খাটিতে হইবে। ইলিশের মরশুম ফুরাইলে বিপুল পদ্মা কৃপণ হইয়া যায। নিজের বিরাট বিস্তৃতিব মাঝে কোনখানে সে যে তার মীন সন্তানগুলিকে লুকাইয়া ফেলে খুঁজিয়া বাহির করা কঠিন হইয দাঁড়ায়। নদীর মালিককে খাজনা দিয়া হাজার টাকা দামেব জাল যারা পাতিতে পারে তাদেব স্থান ছাড়িয়া দিয়া, এতবড়ো পদ্মার বুকে জীবিকা অর্জন করা তার মতো গরিব জেলের পক্ষে দুঃসাধ্য ব্যাপার। ধনঞ্জয় ও যদুর জোড়াতালি দেওয়া ব্যবস্থায় যা মাছ পড়ে তার দু-তিন আনা ভাগে কা্রও সংসার চলে না। উপার্জন যা হয় এই ইলিশের মরশুম। শরীর থাক আর যাক এ সময় একটা রাত্রিও ঘরে বসিয়া থাকিলে কুবেরের চলিবে না।
মাঝরাত্রে একরার তারা খানিকক্ষণ বিশ্রাম করিয়াছে। রাত্রি শেষ হইয়া আসিলে কুবের বলিল, একটু জিরাই গো আজান খুড়া।
জিরানের লাইগা মরস্ ক্যান ক দেহি? বড়িত্ গিয়া সারাড়া দিন জিরাইস। আর দুই খেপ দিয়া ল।
কুবেব বলিল, উঁহুঁ তামুক বিনা গায়ে সাড় লাগে না। দেহখান জানগো আজান খুড়া, আইজ বিশেষ ভাল নাই।
জাল উঁচু করিয়া রাখিয়া কুবের ও গণেশ ছইয়ের সামনে বসিল। ছইয়েব গায়ে আটকানো ছোটো হুঁকাটি নামাইয়া টিনের কোটা হইতে কড়া দা-কাটা তামাক বাহির করিয়া দেড় বছর ধরিয়া ব্যবহুত পুরাতন কল্কিটিতে তামাক সাজিল কুবের। নারিকেল ছোবড়া গোল করিয়া পাকাইয়া ছাউনির আড়ালে একটিমাত্র দেশলাইযের কাঠি খরচ করিয়া সেটি ধরাইয়া ফেলিল। বারো বছর বয়স হইতে অভ্যাস করিয়া হাত একেবারে পাকিয়া গিয়াছে।