গোসা হইলে মারুম গোপির মা।
মারবা নাকি? আগে মার, মার—না যদি মার লখার মাথা খাইবা।
কুবের ঝিমাইতে ঝিমাইতে নিদ্রাকাতর চোখে স্ত্রীর দিকে তাকায়। হ, ছেলে কোলে রোগা বউটিকে তাহার রাজরানির মতো দেখাইতেছে বটে। কে জানে রাজরানি দেখিতে কেমন? ছেলেটাও যেন ফরসাই হইয়াছে মনে হয়, এমনি বয়সে লখা আর চণ্ডী যেমন তামাটে লাল রঙের ছিল সে রকম নয়। আঁতুড়ে যতদিন ছিল কুবের বিশ্বাস করে নাই, এখন তাহার মনে সন্দেহ আসিয়াছে যে ছেলেটা সত্যসত্যই খুব ফরসা হইবে। মালার রং কালো নয, তামাটে—মাঝে মাঝে তাহাকে বাবুদের বাড়ির মেয়েদের মতো ফরসাই দেখিয়া বসে। জেলেপাড়ার কোনো স্ত্রীলোকের গায়ে এমন চামড়া নাই। একটা পা যদি ওর হাঁটুর কাছ হইতে দুমড়াইয়া বাঁকিয়া না যাইত, কুবেবের ঘরে ও পায়ের ধূলা ঝাড়িতেও আসিত না। কিন্তু মালার চেয়েও ছেলেটার রং যেন ঢের বেশি ফরসা হইয়াছে। আরও কিছু বড়ো হইলে বিবর্ণ হইয়া আসিয়া শেষ পর্যন্ত রং হযতো ওর মালার মতোই দাঁড়াইবে। তাই যেন দাঁড়ায়। কুবের তাই চায়। যতই সে শান্ত ও সুবিবেচক হোক, মাঝে মাঝে লোকের বিশ্রী ইঙ্গিতে গা জ্বালা করে বইকী, মালার দিকে চাহিয়া কখনও মনে ঘনাইযা আসে বইকী একটা বিতৃষ্ণা মেশানো ব্যথিত ক্ৰোধ। কুবেরের দৃষ্টি আরও ঘোলাটে হইয়া আসে। এখন, শ্রাবণের এই প্রথম সপ্তাহে আকাশে মেঘের এক মুহুর্তের বিশ্রাম নাই। পরপর কয়রাত্রি অবিরত জলে ভিজিয়া কুবের আবার জ্বর বোধ করিতেছে।
অনেকক্ষণ নীরবে কাটিয়া গিয়াছে, তবু থামিয়া যাওযা আলোচনাটা আবার আরম্ভ কবিতে কোনোরকম ভূমিকার দরকার হয় না। এইমাত্র রাগারগি হইয়া গিয়াছে? কে বলিল! কত শাস্ত ও মোলায়েম কুবেরের গলার স্বর।
স্পষ্ট কইরা যুগল কিছু কয় না গোপির মা। মালার গলাতেও এতটুকু ঝাঁঝ নাই।
কয় না? ক্যান? গোপিরে নিব না?
গণশা কয় নিব, যুগইলা কিছু কয় না। উদিন আমারে জিগায়, খোঁড়ার মাইযা নি খোঁড়া হয়।
তুমি কী কইলা?
আমি কইলাম, তুই বলদ যুগইলা, খোঁড়া নি ব্যারাম যে মার থাকলি মাইয়া পাইবো? আমাগোর গোপির চলন পরির পারা। জান নি গোপির মা, গণেশ মোরে এক বিষম বিত্তান্ত কয়। নকুইলা গিয়া গিয়া যুগইলার নাকি মন ভাঙে, বাকা বাকা মাইয়ার খবর দিয়া আহে। যুগইলা য্যান দুই-দশটা মাইয়ার খবর না নিয়া গোপিরে নিব না সন্দ করি গোপির মা!
বলিয়া কুবের যেন ঘুমাইযা পড়ে। কিন্তু মালা তাহাকে চেনে। সে প্রত্যাশা করিয়া থাকে।
জান নি গোপির মা আরেক বিত্তান্ত? রাসু গোপিরে নিব কয়।
মালা বিস্মিত হয় না। শুধু বলে, চালচুলা নাই।
সায় দিয়া কুবের বোধ হয় এবার সত্যই ঘুমাইয়া পড়ে। কারণ, অনেকক্ষণ অপেক্ষা করিয়াও মালা আর তাহার কোনো মন্তব্য শুনিতে পায় না। বসিয়া বসিয়া ছেলেকে সে স্তন দেয়। রোয়াকের ওদিকে রান্নার জায়গায় বসিয়া পিসি গোপির মাথার উকুন বাছিতেছে, সারারাত উকুনের কামড়ে মেয়েটা মাথা চুলকাইয়া সারা হয়। লখা ও চণ্ডী হয় ডাংগুলি খেলিতে গিয়াছে, আর না হয় কোথাও বড়শি ফেলিয়া ধরিতেছে পুঁটিমাছ। যেখানেই ওরা থাক আর যাই কবুক, জলে ভিজিয়া জ্বরে পড়িবে না, জলে ডুবিয়া মরিবেও না। সে ভয় মালার নাই। সে কেবল ভাবিয়া মরে, মারামারি করিয়া ছেলে দুটা কোনোদিন না খুন হইয়া আসে। পঙ্গু বলিয়া বাহিরের জগতের সঙ্গে মালার পরিচয় কম। কেতুপুরের দশমাইল উত্তরে চরডাঙা গ্রামের এমনই এক ভাঙা কুটিরে তার মায়ের এক বামুন ঠাকুরের নামে কানাকানি করা পাপের প্রমাণস্বরূপ এই ভাঙা পা-টি লইয়া সে জন্মিয়াছিল, বড়ো হইয়াছিল বাড়ির মধ্যে, লাঠিতে ভব দিয়া খোঁড়াইতে খোঁড়াইতে বাড়ির অদূরে রাম গোয়ালার গোয়ালঘরের কাছে কদমগাছটি পর্যন্ত ছিল তাহার কষ্টকর গতিবিধির সীমা। পাড়ার ছেলেমেয়েরা ওই কদমগাছটির তলে খেলা করিত, আর করিত মারামারি। বড়োছেলেরা ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েগুলিকে মারিয়া আর কিছু রাখিত না। অনেক সময় এইসব মারামারির শেষ ফলটা গড়াইত বয়স্কদের মধ্যে, পাড়ায় মহামারি কাণ্ড বাধিয়া যাইত। দূরে দাঁড়াইযা চোখ বড়ো বড়ো করিয়া মালা মজা দেখিত, বড়ো ভয় করিত তাহার। অন্য ছেলে মার খাইলে সে কিছুই করিত না, কিন্তু যে দিন সকলে মিলিয়া তাহার ছোটো ভাই দুটিকে পিটাইতে আরম্ভ করিত সেদিন সে খুলিত মুখ—তাহার বাঁশির মতো সরু গলা শোনা যাইত পাড়ার সর্বত্র, সকলে ছুটিয়া আসিত। তার আগেই মালাকে কিন্তু দিতে হইত ভ্রাতৃপ্রেমের মূল্য। ভাইয়ের বদলে ছেঁচা খাইত সে। একজন একটা ধাক্কা দিলেই সে মাটিতে পড়িয়া যাইত। তখন চার-পাঁচজনে মিলিয়া ধরাধরি করিয়া তুলিযা তাহাকে ফেলিয়া দিত রাম গোয়ালার গোয়ালঘরের পিছনে গোবরগাদায়।
সেই হইতে ছেলেদের মারামারিকে বড়ো ভয় করে মালা। নিজের ছেলে দুটিকে সে ঘরে আটকাইয়া রাখিতে চায়। কিন্তু খাতির তাহাকে কেহ করে না। বসিয়া বসিয়া যাহার দিন কাটে কে তাহার মুখ চাহিবে, কথা শুনিবে? হাজার বারণ করুক মালা, লখা ও চণ্ডী চোখের পলকে উধাও হইযা যায়। ফাকি দিয়া কাছে ডাকিয়া জোর করিয়া ধরিয়া রাখিতে গেলে আঁচড়াইয়া কামড়াইযা একেবারে রক্তপাত করিয়া ছাড়ে। তবু প্রতিদিন মালা তাহাদের নানা ছলে কাছে রাখিবাব চেষ্টার কামাই দেয না। সন্তানস্নেহের হিসাবে জেলেপাড়ার জননীদের মধ্যে মালার মৌলিকতা আছে। ছেলের বয়স আট-দশবছর পার হইয়া গেলে তার সম্বন্ধে চিন্তা করা জেলেপাড়ার মেযেদের রীতি নয়। চিন্তা করিবার অপরাপর বিষয়ের তাদের অভাব নাই। কচি ছেলে ছাড়া মাযের কোল খুঁজিয়া পাওয়া কঠিন। নিষ্ঠুর ছাড়া স্বামীও বড়ো একটা হয় না। দুটি কুঁড়েঘরের কুটিরে যে সংকীর্ণ সংসার, তারও কাজ থাকে অফুরন্ত। পুবুষেরা মাছ ধরিয়া আনে, পাইকারি কেনাবেচা করে, চুপড়ি মাথায করিয়া বাড়ি বাড়ি মাছ জোগান দেওয়া তাদের কাজ নয। ও কাজটা জেলেপাড়ার মেয়েরা সন্তান প্রসবের আগে-পিছে দু-একটা মাস ছাড়া বছর ভরিযা করিযা যায়। অপোগণ্ড শিশু ছাড়া আর কোনো সন্তানের ছোটো ছোটো বিপদ-আপদের কথা ভাবিবারও যেমন তাহাদের সময নাই, ওদের স্নেহ করিবাব মতো মানসিক কোমলতাও নাই। নবজাত সন্তানকে তাহারা যেমন পাশবিক তীব্রতার সঙ্গে মমতা করে বয়স্ক সন্তানের জন্য তাহদের তেমনই আসে অসভ্য উদাসীনতা। ছেলে মরিয়া গেলেও শোক তাহারা করে না, শুধু সুর করিয়া মড়াকান্না কাঁদে। মালা পঙ্গু, অলস। ঘরের কোনায় সে স্বতন্ত্র জীবনযাপন করে, জেলেপাড়ার রূঢ় বাস্তবতা তাই তাকে অনেকটা রেহাই দিয়াছে। ছেলেমেয়েগুলিকে ভালোবাসিবার মতো মনও তাহার আছে, সময়ও সে পায়।