কুবের, গাহান বাইন্ধবার পার?
আমি পারতাম না। আমাগোর যুগইলা পারে। মুখে মুখে ছড়া বাইন্ধ্যা দেয়।
আমি বাইন্ধবার পারি।
কন কী মিয়া বাই?
হোসেন এখন লাজুক। সে এদিক ওদিক তাকায়। ঘনঘন দাড়িতে হাত বুলাইয়া কুবেরের কাছেই অপরাধীর মতো হাসে। লোকটার আদি-অন্ত পাওয়া ভার।
তারপর হোসেন বলে, বাঁধমু, শুনবা?
কুবের বলে, কন মিয়া বাই, কন।
একটু চুপ করিয়া থাকিয়া হোসেন সুর করিয়া বলিতে আরম্ভ করে :
আঁধার রাইতে আশমান জমিন ফারাক কইরা থোও
বোনধু, কত ঘুমাইবা।
বাঁয়ে বিবি ডাইনে পোলা আকাল ফসল রোও
মিয়া, কত ঘুমাইবা।
মানের পাতে রাইতের পানি হইল রুপার কুপি,
উঠা দেখবা না।
আলা করেন ঘরেব চালা কেডা চুপি চুপি,
দিশা রাখবা না।
তোমার লাইগা হাওর দিয়া বাইয়া চেরাগ নাও
দিল-জাগানি আলেন যিনি, মিয়া,
চিরা-মেঘের বাদাম তুইলা বন্ধু কনে যাও?
জিগায় তারে খাঁচার চিড়িয়া।
নিদ্ ভাঙে না, দিল জাগে না, বিবির বুকের শির,
পাড়ি দিবার সময় গেল, মাঝি তবু থির—
মাঝি কত ঘুমাইবা।
কুবের অভিভূত হইয়া বলিল, মুখে মুখে বানাইলেন মিয়া বাই?
খুশ হলি না পারি কী?
হোসেন মিয়া আর দাঁড়াইল না। দুপুর বেলা ঘরের চালের জন্য শণ আনিতে গিয়া কুবের শুনিল, সে বিদেশ গিয়াছে। কোথায় গিয়াছে কেহ জানে না। কিন্তু হোসেন মিয়ার কথা কখনও বেঠিক হয় না। কুবেরের জন্য শণ সে রাখিয়া গিয়াছে।
গোপির বয়স এগারো, কুবের মেয়ের বয়স একবছর ভাড়ায় আর একবছর হাতে রাখিয়া বলে নয়। ন বছর বয়সে যে মেয়ের এগারো বছরের বাড় বিয়ের বাজারে তার দাম আছে। গণেশের শালা যুগল সম্প্রতি পাশের গ্রাম হইতে বোনের তত্ত্ব লইবার ছলে আসা যাওয়া শুরু করিয়াছে। সোজাসুজি কথা সে এখনও পাড়ে নাই, আলাপ আলোচনার মাঝখানে বাঁকা বাঁকা প্রশ্ন করিয়া কুবের কী রকম দর হাঁকিবে জানিবার চেষ্টা করিয়াছে। স্পষ্ট করিয়া কুবেরও এখন পর্যন্ত কিছু বলে নাই। কথা উঠিলে বহুক্ষণ ধরিয়া মেয়ের প্রশংসা কীর্তন করিয়া শুধু একটু আভাস দিয়াছে দুকুড়ি তিনকুড়ি টাকার। বুদ্ধি থাকে যুগল আন্দাজ করিয়া নিক। গণেশের আত্মীয় বলিয়া টাকার বিষয়ে কুবের তাহাকে খাতির করিবে না। যুগল সম্ভবত তাহা টের পাইয়াছে, তাই ইলিশ মাছের মরশুমটা শেষ হইবার প্রতীক্ষায় আছে। হাতে তখন কী রকম টাকা জমে দেখিয়া কথা পাড়িবে। কুবের বোঝে না কী! সকলেব গোপন মতলব সে চোখের পলকে আঁচ করিয়া ফ্যালে।
মানুষ মন্দ নয যুগল। এতকাল অবস্থা খুব খারাপ ছিল, তাই বত্ৰিশ বছর বয়স অবধি বিবাহ করিতে পারে নাই; নিজের চেষ্টায় এখন সে অবস্থা ভালো করিয়াছে। উন্নতির জন্য তাহার প্রশংসনীয় প্রযাসের কথা কাহারও অবিদিত নয়। দুটি একটি করিয়া কতকাল ধরিয়া কতকষ্টে সে কিছু টাকা জমাইয়াছিল, তারপর গণেশের কাছে বোনের বিবাহ দিয়া পাইয়াছিল তেইশ টাকা। সকলে ভাবিয়াছিল, এবার যুগল বিবাহ কলিবে, বিবাহের জন্য ছাড়া অত কষ্টে টাকা জমায় কে? কিন্তু যুগল তা করে নাই। সমস্ত জমানো টাকা দিয়া একটা বড়ো নৌকা কিনিয়া সকলকে সে অবাক করিযা দিয়াছিল। দুশো টাকা সে নৌকাব দাম, সুতরাং টাকা সে কম জমায় নাই। ইচ্ছা করিলে ওই টাকায় সে তিন তিনটা বিবাহ করিতে পারিত। অন্তত একটা বিবাহ করিয়া বাকি টাকায় একটা ছোটোখাটো নৌকা কিনিতে কোনো বাধাই ছিল না। তার বদলে উপার্জনের এই স্থায়ী উপায়ের জন্য সমস্ত পুঁজি ভাঙিয়া সে যে সুবুদ্ধি ও দূরদর্শিতার পরিচয দিয়াছিল তার তারিফ করিতেই হয়। দ্যাখো, একবছরে যুগলের ভাঙা ঘর নূতন হইযাছে, শীর্ণ দেহে মাংস লাগিয়াছে, বিবাহের জন্য টাকাও সে আবার জমাইয়া ফেলিতে পারিয়াছে কিনা কে জানে! জাহাজঘাটে অতবড়ো নৌকার না চাহিতে ভাড়া হয়। রেলে ও জাহাজঘাটে আসিয়া কত মানুষ ও মাল কত গ্রামে যায়, এক একটি বাণিজ্য দ্রব্যের মরশুমের সময় কত মহাজন গ্রামে গ্রামে দাদন-দেওয়া মাল সংগ্রহের জন্য চড়া দরে অসংখ্য নৌকা ভাড়া নেয়। আর শুধু ভাড়া তো নয়। উপরি আয়ও কী কম! ধানের বোঝাই লইয়া একদিনের পথ পাড়ি দিবার সময় দশ-বিশ সের ধান নৌকার গোপন ফাঁকে ফোকরে লুকাইয়া ফেলিবার সুযোগ মেলে ঢের। কেবল ধান নয়, কলাই, মটর, হলুদ, লংকা প্রভৃতি কত কী জিনিস বছর ভরিয়া যুগল অমন কত আনিয়াছে। উন্নতি সে আরও করিবে। কারণ, অবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে কোনো বিষয়ে তাহার এতটুকু শিথিলতা আসে নাই। এখনও সে আগের মতোই কৃপণ। আকুরটাকুরের মাঝি সমাজে আজ সে একজন মাতব্বর লোক। একদিন সেই যে গ্রামের মোড়ল হইয়া দাঁড়াইবে কেহ তাহাতে সন্দেহ করে না।
মালার ইচ্ছা বিবাহটা তাড়াতাড়ি চুকিয়া যায় গোপির। এত বয়স হইল আর কতকাল বয়স ভাড়াইয়া মেয়েকে কুবের ঘরে রাখিবে? লোকে যে ইতিমধ্যেই নিন্দা আরম্ভ করিয়া দিয়াছে। স্বামীকে মালা তাগিদ দিয়া বলে, আগে, যুগইলা নি কিছু কয়? কুবের তাহাকে চোখ ঠারিয়া বলে, কয় না?
কী কয়?
তা শুইনা তর কাম কী? মাইয়ালোক চুপ মাইরা থাক। পোলা বিয়ানের লাইগা পিরথিমিতে আইছস বিয়া পোলা যত পারস–রাও করস কেরে?
মালা রাগে বইকী!
গাও জ্বালাইনা কথা দেহি খইর পারা ফোটে, মায় নি মুখে মধু দিছিল আঁতুড়ে?